রওশন আক্তার ঊর্মি

  ২৪ জুন, ২০২১

মুক্তমত

করোনাকালে প্রতিবন্ধী নারীর কর্মসংস্থান

করোনা মহামারির এ দুঃসময়ে আমরা অনিশ্চয়তা, ভয় আর আতঙ্কে জীবন পার করছি। মৃত্যুভয়ের পাশাপাশি বিষফোঁড়ার মতো যে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে তা হলো, চাকরি চলে যাওয়া, কাজ না পাওয়ার অনিশ্চয়তা। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলছে। তাই অনেক প্রতিষ্ঠান বেতন কমিয়ে দিচ্ছে বা জনবল ছাঁটাই করছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণা তথ্য বলছে, ফরমাল সেক্টরে চাকরি করেন এমন ১৩ ভাগ মানুষ করোনায় এ পর্যন্ত কাজ হারিয়েছেন। চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই এমন মানুষের সংখ্যা আরো বেশি। আর ২৫ ভাগ চাকরিজীবীর বেতন কমে গেছে। এই চিত্রটি পরিস্থিতির ভয়াবহ পরিণতির দিকই ইঙ্গিত করছে। প্রশ্ন হলো, এই কঠিন সময়ে পরিস্থিতি যখন সবার জন্য এতটা খারাপ, সেখানে যারা বিভিন্ন প্রতিবন্ধিতার শিকার, তারা কেমন আছেন।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী দেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৬ জন। তাদের মধ্যে নারী প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৮ লাখ ৩৩ হাজার ২৬৯ জন। তবে বেসরকারি সংগঠনগুলোর মতে, দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা দেড় কোটির বেশি। তাদের মধ্যে অর্ধেকসংখ্যক নারী। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান, সামাজিক সহযোগিতা ও সামাজিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে প্রায় সময়ই বঞ্চিত হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে যারা নারী; তারা একই সঙ্গে ‘নারী’ ও ‘প্রতিবন্ধী’ হওয়ায় বিভিন্ন পরিসরে দ্বিগুণ বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সাম্য ও মৌলিক অধিকারের অঙ্গীকারের ব্যাপারটি উল্লেখ রয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন পাস করেছে। এ আইন দ্বারা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সাম্য, ন্যায্যতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে তার কতটা প্রতিফলন দেখতে পাই? বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে ২০০২ সালে সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি (সিএসআইডি) একটি বড় গবেষণা করেছে, যে চিত্রটা এখনো খুব বেশি পাল্টায়নি। তখন মাত্র ৩ শতাংশ নারী স্কুলে যেত। এখন এ সংখ্যা বেড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। ভালো খবর হচ্ছে, প্রতিবন্ধী নারীদের উন্নয়ন কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সংখ্যা বেড়ে ২১ শতাংশ হয়েছে। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরির কোনো কোটা নেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে যোগ্যতা বিচার করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। লিওনার্ড চ্যাশায়ারের নেতৃত্বে ইনোভেশন টু ইনক্লুশন (আইটুআই) প্রকল্প বাংলাদেশ ও কেনিয়ায় এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে। এ কর্মসূচির অধীনে অনলাইন চাকরির প্ল্যাটফরম বিডিজবসের সঙ্গে একটি চাকরি প্ল্যাটফরম তৈরি করা হয়; যা সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাক্সিক্ষত চাকরি খোঁজা ও আবেদন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ পর্যন্ত এখানে ১৬৩ জনের চাকরি হয়েছে। তবে এরমধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ৪১ জন।

সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টার ফলে প্রতিবন্ধী নারীরা কিছুটা হলেও উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় এসেছিল। এ ক্ষেত্রে কোভিড মহামারি একটা বড় বাধা তৈরি করেছে। কোভিডকালে অনেকে চাকরি ও ব্যবসা হারিয়েছেন। শুধু তাই নয়, করোনা পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী নারীরা অনেক বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, যা তাদের কর্মদক্ষতায় মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ পাঁচ হাজার প্রতিবন্ধীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু ও নারীদের তিন-চতুর্থাংশ মানসিক নির্যাতন আর ৩০ শতাংশের বেশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে যাদের ভাষিক যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তারা তাদের নির্যাতনের ঘটনা কিংবা তাকে কী ধরনের খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না, অপরাধীরা প্রায়ই যেটার অপব্যবহার করে থাকে।

এ ছাড়া প্রতিবন্ধী নারীদের অনেক ক্ষেত্রে কেয়ারগিভার প্রয়োজন হয়, যা করোনাকালে তারা ঠিকভাবে পাচ্ছেন না। বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী নারী করোনাকালে গৃহবন্দি। অনেকের কাছে মোবাইল বা ল্যাপটপ নেই। তাদের জন্য যদি স্বল্প পরিসরে সরকারি বা বেসরকারিভাবে এই ডিভাইস কেনার ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো, পাশাপাশি তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে তারা রাষ্ট্র ও পরিবারের বোঝা হয়ে থাকত না। আবার যেসব প্রতিবন্ধী নারী অনলাইনে ব্যবসা করতে চান, তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা সহজেই স্বাবলম্বী হতে পারত।

নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশে শ্রমবাজার থেকে প্রতিবন্ধী মানুষ বাদ পড়ায় জিডিপির পরিমাণ কমে যায়, যা জিডিপির ৩ থেকে ৭ শতাংশের মতো। ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে কাউকে পেছনে না ফেলে এগোনোর কথা বলা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন ও দারিদ্র্য কমাতে প্রয়োজন আরো কার্যকর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। প্রতিবন্ধী নারীদের পারিবারিক, আর্থসামাজিক বাধাগুলো চিহ্নিত করে তাদের চাহিদাগুলো যদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখা হয়, তাহলে আর্থসামাজিক মুক্তি দ্রুতই সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যেন প্রতিবন্ধী নারীদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নয়।

লেখক : স্পেশালিস্ট, জেন্ডার অ্যান্ড ইনক্লুশন

ইনোভেশন টু ইনক্লুশন প্রকল্প

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close