মো. জিল্লুর রহমান

  ২৪ জুন, ২০২১

দৃষ্টিপাত

জেনেশুনে বিষ করেছি পান

সবাই জানে ধূমপান করলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কিন্তু তার পরও জেনেশুনে মানুষ যেখানে-সেখানে ধূমপান করে। গবেষণায় জানা গেছে, শিশু-কিশোররাও এখন প্রতি ১০ জনে একজন ধূমপায়ী। শুধু ধূমপানই নয়, এরা নানা রকমের নেশাও করে এবং ধূমপানের মাধ্যমেই যেকোনো নেশা শুরু হয়। এতে যেমন তাদের দেহের ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে।

সিগারেটের প্রতিটি প্যাকেটেও লেখা থাকে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, ‘ধূমপানের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষতি হয়’, ‘ধূমপান মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়’, ‘ধূমপান হৃদরোগের কারণ’, ‘ধূমপান ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়’। এসব সতর্কতা সত্ত্বেও ধূমপানের হার ক্রমাগত বেড়েই চলছে। অনেক জায়গায় লেখা থাকে যে, ‘ধূমপানমুক্ত এলাকা’ কিংবা এখানে ধূমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেকে তা খেয়াল করার পরও ইচ্ছাকৃতভাবে যেখানে-সেখানে ধূমপান করে। কেউ এর প্রতিবাদ করলে মনে হয় যেন প্রতিবাদকারীই আসল অপরাধী।

জনসমক্ষে ধূমপান আমাদের দেশে হরহামেশাই দেখা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই এ আইন মানে না। এতে অধূমপায়ী ও শিশুরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে প্রকাশ্য ধূমপানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। এদিকে, প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ আইনের ফলে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ‘অকালজাত শিশু’ জন্মের হার প্রায় ১০ ভাগ কমে গেছে বলে এক গবেষণার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।

আইন অনুসারে জনসমক্ষে, বিশেষ করে গণপরিবহন, বার, রেস্তোরাঁ এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ধূমপানবিরোধী আইন প্রয়োগের ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুদের স্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব ফেলেছে, সে বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, এ আইনের ফলে ইতোমধ্যে বয়স্কদের ক্রমাগত ধূমপানের প্রবণতা কমে গেছে। আজকাল শিশুরাও ধূমপানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিদ্যালয় থেকে বের হয়েই দোকান থেকে বিড়ি বা সিগারেট কিনে তা টানতে টানতে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। স্কুলের বাইরে কেউ কিছু বলবে না এই ভেবে তারা ধূমপান করে। এর ফলে অধূমপায়ী ছাত্রদের ওপরও খারাপ প্রভাব পড়ছে। ধূমপানের কুফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্যানসার এবং শ্বাসকষ্ট। আজকাল এসব রোগের আক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। যার ফলে মানুষের মৃত্যুসংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। ধূমপানের ফলে ফুসফুস, শ্বাসনালিতে নানা রোগ আক্রমণ করে। ধূমপায়ী বাবা-মার সন্তানরাও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ধূমপান একটি বদ-অভ্যাস। এর জন্য বিশ্বে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই মারা গেছে প্রায় ছয় কোটি লোক। আর এদের অর্ধেকই ছিল যুবকশ্রেণি। সিগারেটের ধোঁয়ায় যে নিকোটিন থাকে, তা হিরোইন অপেক্ষা শক্তিশালী। ধূমপানকারী পরিবার, দেশে ও সমাজে সর্বমহলে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত হয়। ধূমপান হলো সবচেয়ে বড় অপচয় এবং নিয়মিত ধূমপান মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে। কারণ সে নিশ্চিত জানে যে, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তার পরও সে তা পান করে। ধূমপায়ী তার ছেলেসন্তান এবং উত্তরসূরিদের জন্য একজন আদর্শহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

ধূমপান মানুষের অপমৃত্যু ঘটায়। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সমগ্র পৃথিবীতে ধূমপানের কারণে যত বেশি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে, অন্য কোনো রোগব্যাধির কারণে তত ঘটে না। ধূমপানের কারণে শরীরে তাপ বৃদ্ধি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগব্যাধি দেখা যায়। ধূমপানের কারণে রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং অনেক সময় তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপানকারীর ফুসফুস, মূত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিহ্বা ও কণ্ঠনালি, কিডনি ইত্যাদিতে ক্যানসার হয়। ধূমপান স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দুর্বল করে দেয়। ইন্দ্রীয় ক্ষমতা দুর্বল করে। বিশেষ করে ঘ্রাণ নেওয়া এবং স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা লোপ পায়।

ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমে যায়। উইনকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭৫০ জন লোকের ওপর এক সমীক্ষা চালায়। সেখানে লক্ষ করা যায় যে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমার সম্ভাবনা শতকরা ৭০ ভাগ বেশি। গবেষকরা আরো দেখেছেন যে, একজন ধূমপায়ীর ধূমপানকালীন কোনো অধূমপায়ী উপস্থিত থাকলে তারও একই সমস্যা দেখা দেবে। ধূমপানের ফলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বারবার সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। ধূমপায়ী সব সময় দুর্বলতা অনুভব করে এবং আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। হার্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত ধমনিগুলো ব্লক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। এমনকি বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধূমপান উচ্চরক্তচাপের কারণ হয়। ধূমপানের ফলে যৌনশক্তি বিলুপ্ত হতে থাকে। ধূমপানের ফলে হজমশক্তি কমে যায়, ধারণক্ষমতা লোপ পায় এবং শরীর ঢিলে হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে পাকস্থলী ক্ষত হতে থাকে এবং যকৃৎ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধূমপানের ফলে মূত্রথলি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং প্রস্রাব বিষাক্ত হয়।

ধূমপান নির্মল পরিবেশকে দূষিত করে। এর ফলে স্ত্রী-পরিজন, সহযাত্রী, বন্ধুবান্ধব ও আশপাশের লোকজনের কষ্ট হয়ে থাকে। বাসে, ট্রেনে ও অন্যান্য যানবাহনে প্রকাশ্যে ধূমপান করার ফলে অনেক সহযাত্রী নীরবে কষ্ট সহ্য করে মনে মনে ধূমপায়ীকে অভিশাপ দেন। আবার কেউ প্রতিবাদ করে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। অনেকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপমানিত হন। জেনে রাখা উচিত, চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, ধূমপানকারীর প্রতিবেশী শারীরিকভাবে ধূমপায়ীর মতই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূমপানজনিত ক্ষতি ও অকালমৃত্যু গরিবদেরই বেশি হয়। ১২২ কোটি লোকের মধ্যে ১০০ কোটিই উন্নয়নশীল দেশে বাস করে। ২০০২ সালের হিসাবমতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ধূমপায়ীর সংখ্যা প্রতি বছর ৩.৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৪ সালে হিসাব করেছিল যে, সারা বিশ্বে ৫৮.৮ মিলিয়ন লোক মারা যায়। যার মধ্যে ৫৪ লাখ ধূমপানজনিত কারণে এবং ২০০৭ সালে তা ৪৯ লাখে নেমে আসে। ২০০২ সালে ৭০ শতাংশ মৃত্যুই ঘটেছিল উন্নয়নশীল দেশে। অল্পবয়সি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এই প্রবণতা অনেক বেশি। এর জন্য অনেকে কোম্পানিগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপনকে দায়ী করে। কারণ এই বয়সের ছেলেমেয়েরা এ রকম বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের আড়াই কোটিই ধূমপায়ী। জর্দা, সাদা পাতা, গুল হিসেবে আনলে এ সংখ্যা ৪ কোটি ১৩ লাখ। ধূমপানের কারণে অকালেই ঝরে পড়ছে বহু তাজা প্রাণ।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তামাকজনিত ব্যাধি ও অকালমৃত্যুর কারণে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৩০ বছর বা এর বেশি বয়সিদের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সি ৪ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি শিশু তামাকজনিত রোগে ভুগছে। এদের ৬১ হাজারেরও বেশি (১৪ শতাংশ) শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৭১৮ জন। যা জাতীয় পর্যায়ে সব মৃত্যুর প্রায় ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে ব্যয় বাড়ে ৪ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এরমধ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যক্তিগত ও সরকারি ব্যয়, অক্ষমতা বা অসুস্থতার কারণে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি এবং অকালমৃত্যুর কারণে উৎপাদনশীলতার ক্ষতিও অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েল বিং এর মতে, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণের বিদ্যমান আইনটি সর্বশেষ সংশোধন হয়েছে ২০১৫ সালে। এত দিনে বদলে গেছে দৃশ্যপট। অনেকেই আবার পাবলিক প্লেসে ধূমপান শুরু করেছে। এটা কমাতে করের হারও বাড়ানো প্রয়োজন। তাই আইন সংশোধন জরুরি। সংসদের প্রায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য ইতোমধ্যে তামাকের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করেছেন। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।’

ধূমপানে বিষপান, এটা জীবন ও শরীর উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপায়ীর মতো তার পাশে থাকা অধূমপায়ীও সমান ক্ষতি ও ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ বিষয়টি অনুধাবন করে ধূমপান রোধের জন্য সবার আগে আমাদের নিজেদের সচেতন ও বদলাতে হবে। আসুন আমরা সবাই ধূমপান ছাড়ি, ঝুঁকিমুক্ত জীবন গড়ি।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close