ফারহান ইশরাক
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাঙালির অনন্য আস্থা
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশ নামের এই জনপদটি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল বৈদেশিক শাসকগোষ্ঠীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ভিনদেশি বণিকরা বাণিজ্যের জন্য এ দেশে এলেও ঘাঁটি গড়েছিল বঙ্গ নামের এই অঞ্চলকে শাসনের নামে শোষণ করার জন্য। এভাবে দিনের পর দিন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকেও বাংলার মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখত, স্বপ্ন দেখত নিজেদের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিজের দেশের মানুষের হাতে তুলে দিতে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দেশীয় নবাব, জমিদাররা বিদেশি শাসকগোষ্ঠীকে পরাস্ত করে বাংলাদেশে শাসনকার্য পরিচালনা করলেও এ অঞ্চলের মানুষ কখনোই কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। কিন্তু তারা ঠিকই স্বাধীনতার স্বপ্ন জিইয়ে রেখেছিল।
২৩ জুন তারিখটি বাঙালির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় একটি দিন। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন বাংলা, বিহার, ওড়িশার সর্বশেষ স্বাধীন নবাব। ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীর প্রান্তরে নবাবের বাহিনী পরাজিত হয় ইংরেজদের হাতে। বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় দীর্ঘদিনের জন্য, শুরু হয় পরাধীনতার অন্ধকার যুগ। আবার ১৯৪৯ সালের এই দিনটিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় এক রাজনৈতিক দল, যার হাত ধরে বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতার আজন্ম লালিত স্বাদ। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই দেশের মানুষের দাবি আদায়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখে আসছে। ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটির নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিনের পথচলায় ৭২ বছর অতিক্রম করে আজ ৭৩-এ পদার্পণ করছে দলটি।
উপমহাদেশের বুকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালনকারী প্রথম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সূচনালগ্ন থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার যে সাহসী দায়িত্ব দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল, কালের পরিক্রমায় নেতৃত্বের বদল ঘটলেও নীতিগত অবস্থান থেকে বিচ্যুতি ঘটেনি দলটির। বলা যায়, এটিই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের আদর্শ ও চেতনার শক্ত অবস্থান দলটির ভিত্তিকে মজবুত করেছে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের সৃষ্টি হয়। দেশ দুটি সৃষ্টির পর তাই স্বভাবতই ধর্মকে কেন্দ্র করে এই দুটি দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক মতাদর্শের দল ছিল আওয়ামী লীগ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল দলটির মূল আদর্শ। তাই দীর্ঘদিনের পদযাত্রায় বারংবার আঘাতে জর্জরিত হলেও আওয়ামী লীগকে কেউ দমাতে পারেনি। প্রতিবারই স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে নিজ অস্তিত্বের বিজয় নিশান উড়িয়েছে দলটি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আরো একটি বড় শক্তির জায়গা হলো এর নিবেদিত কর্মী বাহিনী, প্রচন্ড দুর্দিনেও যারা দলটির হাল ধরে রেখেছেন। তীব্র অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেও এই দলটির বহু কর্মী আজীবন নিজেদের আদর্শের জায়গায় অবিচল থেকেছেন, নিজের জীবনকে বাজি রেখে আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি কথা বেশ প্রচলিত। তা হলো, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের দল। এই দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের কর্মীরা জীবনভর জেল, জুলুম, অত্যাচার সহ্য করে নিজ দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি কর্মীদের আত্মনিবেদনের একটি দারুণ উদাহরণ আমরা দেখতে পাই দলটির সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনে। ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতেও ১০৪ বছরের বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইসাহাক আলী মাস্টার সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন দলকে ভালোবেসে। কর্মীদের এই ভালোবাসাই আওয়ামী লীগের এগিয়ে যাওয়ার জ্বালানি।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য। একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সব থেকে বেশি প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব। পৃথিবীতে বহু জাতি দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও কেবলমাত্র দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবে এখনো পর্যন্ত স্বাধীনতার স্বাদ অর্জন করতে পারেনি। এই নেতৃত্বদানের সক্ষমতাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে দিয়েছে অনন্যতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুক্তিসংগ্রামে দলটি জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে, উপহার দিয়েছে স্বাধীনতা নামের চির আরাধ্য ফসল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ এই তিনটি নাম একই সূত্রে গাথা। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বঙ্গবন্ধুর মতো একজন অবিসংবাদিত নেতার সান্নিধ্য পেয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সব থেকে স্মরণীয় কয়েকটি ঘটনার যদি সময়ানুক্রমিক তালিকা করা যায়, তবে শুরুতেই থাকবে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন। এরপর পর্যায়ক্রমে ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই প্রতিটি আন্দোলনেই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য আওয়ামী লীগের বহু নেতাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। ৬৬-এর ছয় দফা ছিল বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতার ফসল। ছয় দফার দাবিতেও আওয়ামী লীগ ছিল সরব। ১৯৬৯-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশ পরিচালনার জন্য যে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল, তারও এগিয়ে চলা এই দলটির হাত ধরেই। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, বহির্বিশ্বে জনমত সৃষ্টিসহ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বপক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব আর ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশকে আলোর পথ দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। ৭৫-পরবর্তী সময়ে দেশে সামরিক শাসনের যে অন্ধকার অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্য একটি শক্তিশালী আন্দোলন ছিল সময়ের দাবি। সেসময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, যার ফলস্বরূপ ৯০-এ এরশাদ সরকারের পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করে দেশকে যখন আরো একটি অগণতান্ত্রিক কালো অধ্যায়ের যুগে নিয়ে যাওয়ার নীলনকশা চলছিল, সেসময় সব অপশক্তিকে রুখে দিয়ে জনগণের বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে এই আওয়ামী লীগ-ই নিয়ে এসেছিল। স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করার সাফল্যও এসেছে এই দলটির হাত ধরেই। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মাইলফলক পদ্মা সেতু নির্মাণ, জনগণের দোরগোড়ায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছানো, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়াসহ দেশের প্রতিটি গৌরবজনক অর্জনের পথচলার সঙ্গী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে একটি রাজনৈতিক দলের এমন অবদান পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের হাল ধরেছে, দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে সব বিপদ মোকাবিলায়। দলটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে কিংবদন্তিতুল্য নেতৃত্বের উপহার দিয়ে আসছে। প্রতিটি দুর্যোগ, দুর্বিপাকে মানুষকে সাহস জুগিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই দলটি তাই বাঙালির পরম ভরসার স্থান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতির প্রচন্ড আস্থার প্রতীক, অনুপ্রেরণার বাতিঘর। এখনো বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, করোনা মহামারির এই দুর্দশা থেকে মুক্তির দিনগুলোয়ও প্রতিবারের মতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের পাশে থাকবে, জনগণকে সাহস সঞ্চার করবে ঐতিহাসিক মশালের মতো। করোনাভাইরাসের টিকা লাভের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যে বিচক্ষণতা দেখিয়েছে, তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে অনুকরণীয়। উপমহাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্মদিন তাই প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে এক আনন্দোৎসবের নাম। জনগণের ভালোবাসার শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বেঁচে থাকুক চিরকাল।
লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"