অধ্যক্ষ আকমল হোসেন
মুক্তমত
করোনাকালীন শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা
শিশুর পুষ্টির জন্য যেমন মায়ের দুধের বিকল্প নেই; তেমনি শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠনে মা-বাবার ভূমিকারও বিকল্প নেই। শিশুর মানস গঠন, দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ করে গড়ে তুলতে বাড়িতেই দিতে হবে প্রাথমিক পাঠ। শিক্ষা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, অপ্রতিষ্ঠানিকও বটে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ৫ বছর বয়সে কোনো কোনো দেশে তারও আগে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই শিশুর শিক্ষার ভিত্তি, যেখানে গৎবাঁধা নিয়মনীতি নেই, আপন মনে চলতে-ফিরতে হাঁটতে খেলতে এমনকি গড়াগড়ি করেও শেখে। সে শেখে নিঃসংকোচে নির্ভয়ে। প্রকৃতি এবং পরিবেশই হলো শেখার আদি পিঠস্থান। শুধু মানুষই নয়, যেকোনো জীবের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। মানুষ শেখে শুনে, পড়ে, দেখে ও কাজ করার মধ্য দিয়ে। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকে ৪-৬ ঘণ্টা, দিনের বাকি ২০-১৮ ঘণ্টা থাকে বাড়িতে অর্থাৎ মা-বাবা বা আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে। শিক্ষার অন্যতম নিয়ামক শক্তি হলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক। পড়াশোনা জানা অথবা বোঝার জন্য শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও আন্তরিকতাই যথেষ্ট। তবে সেই আন্তরিকতা সৃষ্টিতে পরিবার এবং বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ্।
ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিশু অবস্থায় পথ চলতে চলতে রাস্তার পাশের মাইলস্টোন দেখে সংখ্যা ধারণা অর্জন করেছিলেন। আর্থিক দৈন্যের কারণে বিদ্যুতের লাইট পোস্টের আলোতে পড়তেন। শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কমিউনিটি এবং সরকারের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এদের মধ্যে একটি সুষ্ঠু সমম্বয় হওয়া জরুরি। শিক্ষকদের প্রধান কাজ দুটি, একটা হলো শিক্ষার্থীদের মনে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করা; আর অন্যটি হলো না জানার আগ্রহকে নিবৃত্ত করা। সেই কাজ দুটি করার ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান নয়। শিক্ষকরা সমাজের অংশ, সমাজের বাইরে তার যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে এটা সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। শিক্ষকরা যতক্ষণ শিক্ষাথীদের নিজের সন্তান হিসেবে ভাবতে পারবেন না, ততক্ষণ তাদের দ্বারা ভালো কিছু আশা করা সম্ভব নয়। অনেকেই বলে থাকেন আগের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘরগুলো ছিল কাঁচা আর শিক্ষকরা ছিলেন পাকা আর এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘরগুলো হয়েছে পাকা আর শিক্ষকরা হয়েছেন কাঁচা।
১৯৬৬ সালে আইএলও-এর কনভেনশনে শিক্ষক সমাজের অ্যাকাডেমিক ফ্রিডমের কথা থাকলেও বিভিন্ন দেশে সেটাকে উপেক্ষা করে চলছে, সেসঙ্গে ভোগবাদী সমাজ মানুষকে মুনাফামুখী এবং আত্মকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলেছে, যে কারণে আজকের শিক্ষক সমাজ পাঠদানের ক্ষেত্রে কর্তব্যবোধের পরিবর্তে দায়িত্ব বোধকে নিয়ে ক্লাসে যায়। রুটিন সময়ের পুরোটা ক্লাসেও থাকে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সেক্ষেত্রে রবীন্দনাথের সেই কথাই যেন সত্য হয়ে যায় ‘প্রভু তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি।’ শিক্ষকরা শিক্ষাথীদের নিয়ে যান তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারে, যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়েছে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য ছাত্র ধরার ফাঁদ, যেমন সরকারি হাসপাতালগুলো হয়েছে রোগী ধরার ফাঁদ। এসব কারণে শিক্ষা বাণিজ্য এবং লাভ-অলাভের মতো পণ্যের পর্যায়ে এসেছে। পড়াতে হলে শিক্ষকদেরও পড়তে হয়; কিন্তু সেটাকে বাদ দিয়ে তারা ছুটছে ব্যক্তিগত স্বার্থের খোঁজে। পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের আগ্রহ এবং কমিটমেন্ট থাকতে হয়। এমনকি সমাজেরও স্বার্থ দেখতে হয়, সেটা এ আমলে কমতে শুরু করেছে। আজকের শিক্ষকরা আগের মতো কমিটেড নয়, প্রচলিত সমাজের সঙ্গে টিকে থাকার জন্য তাকে এই কাজের পাশাপাশি অন্য কাজেও মনোনিবেশ করতে হয়। যে কারণে শিক্ষার মতো জীবন গঠনের অন্যতম নিয়ামক এই শক্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এ ছাড়া সব অভিভাবকই প্রত্যাশা করছেন তার ছেলেমেয়েকে এ+ পেতে হবে; ডাক্তার, প্রকৌশলী হতে হবে- সেটা টাকা দিয়ে হলেও। ফলে সনদনির্ভর শিক্ষা এবং তার ফল বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জানা এবং শেখার আগ্রহ কমছে। করোনাকালে এই বিষয়টি আরো তীব্র হয়েছে, কারণ বয়সের কারণে নেটভিত্তিক অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এটা শুধু ক্ষতির কারণই নয়, দৃষ্টিশক্তির জন্যও বড় ধরনের সমস্যা। দীর্ঘ সময় বাসাবাড়িতে অবস্থানের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মন বসছে না বলে অভিভাবকদের মত। তাদের বক্তব্য করোনার কারণে দেশের অনেক কিছুই সীমিত পরিসরে চলছে, পাঠদান কার্যক্রমও সেভাবে চালানো কষ্টকর। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনও সে ধরনের বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পত্রিকায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহ্বান করেছেন। তবে সরকার করোনা পরিস্থিতির এ সময়ে নানাভাবে শিক্ষাকে গতিশীল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে শিক্ষার সূতিকাগার হলো পরিবার। তাই বলা যায়, করোনাকালে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে মা-বাবার ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ
কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
(বাকবিশিস) কেন্দ্রীয় কমিটি
"