অলোক আচার্য

  ২১ জুন, ২০২১

পর্যালোচনা

পরিকল্পিত নগরায়ণই নান্দনিক নগরের সূতিকাগার

আমাদের তিলোত্তমা নগরী রাজধানী ঢাকা বিশ্বের বসবাসের অনুপযুক্ত শহরগুলোর তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে এসেছে। বসবাসযোগ্যতা ও নাগরিক সুবিধাগত দিক থেকে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর অবস্থান বিষয়ক জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তাদের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। একটি শহর কেন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠে বা কেন যোগ্য হয়ে উঠে এর দায় আসলে কার ওপর বর্তায়? এসব কিছুর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায় থাকে বসবাসকারী মানুষের। রাজধানীর এই অবস্থানের পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এক. ঢাকামুখী জনস্রোত বন্ধ করতে না পারা। দুই. পরিবহন সংখ্যা মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ছে। তিন. সুপেয় পানির সংকট ঘনীভূত হচ্ছে চার. গাছপালা কমে পরিবেশ মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। পাঁচ. পরিকল্পনা থাকলেও সেসব বাস্তবায়নে শ্লথগতি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা একটি অপরিকল্পিত শহর। বিশে^ অনেক বড় বড় শহর রয়েছে, যেগুলো অনেক বড় এবং ঘনবসতি। কিন্তু সেসব শহর পরিকল্পিত। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্রোতের মতো মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। আবাসনের নিশ্চয়তা, চাকরির নিশ্চয়তা, উন্নত জীবন গড়ার নিশ্চয়তায় সবাই ঢাকামুখী। আমাদের দেশে মুখে মুখে প্রচলিত আছে গ্রামে থেকে কিছু হবে না, ঢাকা যাও। সঙ্গে সঙ্গে তল্পিতল্পাসহ ঢাকায় চলল। ঠিকই ব্যবস্থা হয়ে যায়। প্রাণের শহর ঢাকা কাউকে ফেরাতে দেয় না। স্বাভাবিকভাবে শহরগুলোর জনসংখ্যা একটু বেশি হয়। নানা রকম সুযোগ-সুবিধার কারণে এটা ঘটে। তবে সেসব দেশে বিভিন্ন শহরে পরিকল্পনা করে কাজের ক্ষেত্র গড়ে তোলা হয়। আর আমাদের সব সুযোগ-সুবিধা রাজধানীকেন্দ্রিক।

সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ঢাকায় অবস্থিত। একটা চাকরির পরীক্ষার জন্য ঢাকায় দৌড়াতে হয়। যতই ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হোক না কেন ঢাকামুখী জনস্রোত তাই থামছে না। উন্নয়নবৈষম্য এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে ঢাকায় যে সুযোগ পাওয়া যায় তা কোনো জেলা শহর এমনকি বিভাগীয় শহরেও পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুর‍্যো এক তথ্যে বলা হয় যে, গ্রামে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি আর শহরে ব্যয়ের তুলনায় আয় বেশি। আর এ কারণে বেশি জীবিকার আশায় দরিদ্র মানুষ ঢাকার দিকে ছুটছে। নদীভাঙন বা অন্য কোনো কারণে উদ্বাস্তু মানুষের শেষ ঠিকানা ঢাকা। কারণ ঢাকা এলেই জীবিকার একটা ব্যবস্থা হবেই এমনটা ভেবে নেয়। অনেক আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, আমাদের বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যেতে হবে। বিশ্বেও সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে ঢাকা এখন সারা দুনিয়ার কাছে বিস্ময়। কীভাবে এই শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ বসবাস করে, তা এখন একটি গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ১৯৭০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লাখ। ২০০১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ৮৪ লাখ। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। বোঝাই যাচ্ছে এখন জনসংখ্যা আরো বেশি।

জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টেও তথ্য অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ এই জনসংখ্যা ৩ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্বের ১১তম মেগাসিটি। আমাদের সামগ্রিক জনসংখ্যা বাড়ছে। তারপর রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা আরো দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ঢাকামুখী জনস্রোত ছাড়াও প্রতিদিন নতুন নতুন শিশুর জন্ম হচ্ছে। গড়ে উঠছে বস্তি। বাসস্টেশন, রেলস্টেশন কোথাও মানুষের বাসস্থান তৈরি বাদ নেই। চারদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। এদিক, সেদিন টাকার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুবেদার ইসলাম খাঁর আমলে ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করা হয়। মোগল আমলে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৯ লাখ।

ব্রিটিশ আমলে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারালে ঢাকার জনসংখ্যা কমতে থাকে। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রথম দশকে ঢাকাকে যখন পূর্ববাংলা ও আসাম নামের নতুন একটি প্রদেশের রাজধানী করা হয়, তখন থেকে আবারও এর জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকা অপরিকল্পিত নগরী এটা যেমন ঠিক, তেমনি আজকের ঢাকা যে অবস্থায় এসেছে তার জন্য কেবল অপরিকল্পিত নগরী কথাটিই দায়ী নয়। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এই অপরিকল্পিত নগরীকে পরিকল্পিত করে গড়ে তোলা যেত। কিন্তু শুরুতেই তার কোনো উদ্যোগ ছিল না। যখন বিষয়টি বুঝতে পারল, তখন কেবল পরিকল্পনা গ্রহণের মধ্যেই সীমাবন্ধ থেকে গেল। দখল হতে হতে ঢাকার আশপাশের খালগুলো দখল হয়ে গেল। সেখানে গড়ে উঠল বিরাট বিরাট সব অট্টালিকা। তারপর খাল দখল হওয়ার পর নদী দখলের কার্যক্রম শুরু হলো। অথচ আমরা ভুলেই গেলাম পানির উৎস বন্ধ করে বেশি বছর সুস্থভাবে বাঁচতে পারব না। তারপর যেখানে তিনতলা বিল্ডিং করা সম্ভব না, সেখানে পাঁচ তলা নির্মাণ করে বসে থাকলাম। এত দিন পর বুঝতে পারছি বড় ধরনের ভূমিকম্পে ঢাকার এসব বিল্ডিংয়ের প্রায় সবই ধসে পড়বে।

এত দিনে বুঝলাম এসব অপরিকল্পিত। কিন্তু তত দিনে পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। দেশের সব সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস গড়ে তোলা হয়েছে রাজধানীতে। ফলে দেশের সব প্রান্ত থেকে চাকরিপ্রার্থীরা ছুটে ঢাকার দিকে। আর এসব যন্ত্রণায় তারা জীবনটাই ঢাকায় সাজিয়ে নিতে চায়।

এখন গ্রামেও শহরের বাতাস লাগলেও কাজের কিছু ক্ষেত্র তৈরি হলেও তা ঢাকামুখী জনস্রোত ঠেকাতে আরো বেশ কয়েক বছর সময় নেবে। এসব কারণে দিনে দিনে ঢাকার যানজট, জলাবদ্ধতা, দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থা খারাপ হচ্ছে। সুষম ও বাসযোগ্য আবাসন ব্যবস্থার অভাবে নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে। আজ যে ঢাকা দ্বিতীয় বসবাসের অযোগ্য শহর হয়েছে তার দায় আমাদের। তিলোত্তমা নগরীকে আমরাই ধ্বংস করেছি। তাই আজ ঢাকাকে বাঁচাতে হবে। ঢাকাকে আধুনিক ও বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। ঢাকামুখী জনস্রোত থামাতে হবে। সেজন্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোকে পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। সরকারি-বেসকারি কিছু অফিসের প্রধান শাখা বিভাগীয় শহরগুলোয় দেওয়া যেতে পারে। উপজেলা শহর ও জেলা শহরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যে কারণে মানুষ ঢাকামুখী হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে তা দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে ঢাকার আশপাশে থেকে ও অন্যান্য শহর থেকে মানুষ ঢাকামুখী হবে না। ঢাকা শহরের টেকসই উন্নয়নের জন্য এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। গড়ে ওঠা অবকাঠামো হবে পরিকল্পনামাফিক ও সুশৃঙ্খল।

একটি শহর সুষ্ঠু পরিকল্পনায় গড়ে তোলা হলে এবং শহরের নাগরিক যদি শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে; তাহলে সেই শহর বাসযোগ্যই হবে। অর্থাৎ শহরকে বাসযোগ্য করতে নাগরিক দায় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ঢাকা শহর আজ কংক্রিটের জঞ্জাল। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং গাছপালা উজাড় করে শহরায়ণ এসবই আজ আমাদের অযোগ্য শহরের তালিকায় নিয়ে গেছে। এখন তো সেটি অযোগ্য তালিকায় রয়েছে। এর চেয়েও আশঙ্কার কথা হলো, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, প্রতি বছর বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে আশঙ্কাজনক মাত্রায়। এ ধারা ঠেকানো না গেলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পাঁচটি প্রধান জনবহুল মহানগরী আগামী এক দশকের মধ্যেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে। এখন যে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তা ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকবে। সেখানে যদি পরিবেশের ক্ষতি করে নগরায়ণ করতে চাই, তবে তা ক্রমেই ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে। সুতরাং ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে অবশ্যই নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং পরিকল্পিত নগরায়ণে মনোযোগ দিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close