ফুয়াদ হাসান

  ২১ জুন, ২০২১

বিশ্লেষণ

অতিমারিকালীন অর্থনীতি ও শ্রমবাজার

বর্তমান পৃথিবীর বুকে ধেয়ে চলেছে প্রাণনাশকারী মহামারি করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালে শুরু হলেও এখনো তার দাপট বিন্দুমাত্র কমেনি। এরই মধ্যে হাজার হাজর মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। জীবনযাপনের ন্যূনতম অধিকার কেড়ে নিয়েছে কোটি জনতার। গৃহবন্দি পৃথিবীর আকাশ-বাতাস কালো মেষে ছেয়ে আছে স্বজনহারাদের অব্যক্ত আর্তনাদে। প্রকৃতির এক নির্মম কান্ডে মুহূর্তে অপারগ বানিয়ে দিয়েছে পৃথিবীবাসীকে। তথ্যপ্রযুক্তি আর রণক্ষেত্রের কি রমরমা দামামা পুরো বিশ্বে। মুহূর্তে সুসজ্জিত অট্টালিকাকে পরিণত করে মৃত্যুপুরীতে। সাগরের বিশাল জলরাশিকে বসে আনার কী সব অদ্ভুত কর্মকান্ড। শুধু কি পৃথিবীতে, মানুষ তার মহত্ত্ব আর ক্ষমতার প্রদর্শনে একটুও ছাড় দেয়নি মহাকাশেও। কিন্তু প্রকৃতি তার ছোট্ট এক কিট দ্বারা মুহূর্তে পৃথিবীবাসীকে বুঝিয়ে দিল আসলে মানুষ কতটা অসহায় (যদিও করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক নাকি মানবসৃষ্ট, তা নিয়ে যথেষ্ট তর্ক রয়েছে বিশ্বরাজনীতিতে)।

তার পরও একটু বাঁচার জন্য কী আর্তনাদ পৃথিবীব্যাপী। জীবনের ব্যস্ততাতে ছুটি দিয়ে মুহূর্তে গৃহবন্দি হতে হলো সারা পৃথিবীকে। করোনার হাত থেকে বাঁচতে পৃথিবীজুড়ে লকডাউনের ঝড় বয়ে গেল (ব্যতিক্রম ছিল সুইডেনে)। যার ফলে বন্ধ হয়ে গেল বিশ্ববাণিজ্যের সব কর্মব্যস্ততা। করোনা মহামারি হতে বাঁচতে গৃহীত পদক্ষেপের দরুন সবচেয়ে বিপাকে পড়ে বিশ্বজুড়ে বিচরণ করা তৃণমূল মানুষগুলো। কর্ম হারিয়ে অনেকটা মানবিক জীবনযাপনে বাধ্য হলো শত শত আদম সন্তান। মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিকল হয়ে পড়ে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। মন্দার সময় শ্রমবাজারে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্র নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। উৎপাদনের গতি হ্রাস হলে শ্রমের চাহিদা নিম্নমুখী হয়, যার ফলে কর্মসংস্থান কমার পাশাপাশি মজুরি কমিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। শুধু তাই নয়, শ্রমবাজারে শ্রমের চাহিদা কমে গেলে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরিও কমে যায়। শ্রমের চাহিদা ও কাজের সুযোগ কমে গেলে কর্মপ্রার্থীদের স্বল্পকালীন নমনীয় শর্তের ভিত্তিতে চুক্তি করা হয়। মজুরি নিয়ে দরকষাকষির সুযোগ হ্রাস হয়ে যায় এবং তার ফলে আগের চেয়ে কম মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ করা সহজ হয়। এজন্য শ্রমিকের আয় কমে। কর্মহীন বা সামান্য মজুরিতে কোনো রকমে টিকে থাকা শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়ার ফলে তাদের চাহিদা ও ভোগপ্রবণতা কমে যায়, ফলে সামগ্রিক উৎপাদনও কমে যায়। আর উৎপাদন হ্রাস হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও অর্থনীতির অগ্রগতি ব্যাহত হয়। লকডাউনের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঠিক অনুরূপ ঘটনা ঘটে। ফলে বিশ্বব্যাপী কর্মহীনদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়ে।

আধুনিক যুগে বিশ্ব অর্থনীতি একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। একটি দেশ বিকল হয়ে পড়লে তার বিরূপ প্রভাব বিশ্বজুড়ে পড়ে। মহামারি থেকে বাঁচতে গৃহীত লকডাউনের ফলে ঠিক একইভাবে বিশ্ব অর্থনীতি অকেজো হয়ে পড়ে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে, ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় তার জিডিপির ১০৬ শতাংশ। অন্য দেশগুলো ঠিক একইভাবে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। মহামারিকালে লকডাউনের ফলে অর্থনীতিতে যে মন্দার সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে চাহিদা সংকট নাকি সরবরাহ সমস্যা, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি মহলে। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, সমস্যাটি সরবরাহের দিক থেকে সৃষ্টি। আবার কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, সমস্যাটি সরবরাহের দিক থেকে হলেও দ্রুতই চাহিদার সংকট সৃষ্টি হয়। তবে বেশিসংখ্যক বিশ্লেষক মনে করেন, আপৎকালীন সমস্যাটি সরবরাহ ও চাহিদার সংকট দুদিক থেকেই সৃষ্ট। তবে সংকট যেভাবেই হোক না কেন, তা কিন্তু দৃশ্যমান। আর এই দৃশ্যমান সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি গুনছে কর্মহীন তৃণমূল শ্রমজীবী মানুষ।

করোনার ফলে বিশ্বে যে কর্মহীন বা বেকারের সংখ্যা বেড়েছে, এই সংখ্যায় দেশভেদে বেশখানিকটা তারতম্য রয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেশভেদে শ্রম আইনের তারতম্যকে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাছাড়া মহামারিকালে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপও (যেমন বেকার ভাতা, কর্মী ছাঁটাই রোধ, চাকরি বাঁচিয়ে রাখা, ইউরোপের সোশ্যাল মডেল) এই তারতম্য সৃষ্টি করেছে। সারা দুনিয়ায়জুড়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত কর্মঠ মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। আর এ খাতে শ্রমিকের চাকরির নিশ্চিয়তা খুবই নগণ্য। যেকোনো সময় শ্রমিক ছাঁটায়ের মতো ঘটনা ঘটে। তবে উন্নত দেশে দুই ধরনের শ্রমবাজার লক্ষ করা যার; যুক্তরাষ্ট্রের গতানুগতিক বাজারভিত্তিক ব্যবস্থা আর ইউরোপের ‘সোশ্যাল মডেল (যার মূলকথা হলো শোভন কর্মসংস্থান এবং সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে একটি কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা)’। এ ক্ষেত্রে প্রথমটিতে সহজে শ্রমিক ছাঁটাই হলেও বেকারত্ব ভাতা প্রধান করা হয়। ফলে বেকার হলেও স্বাভাবিক জীবনধারণ সম্ভব হয়। অন্যদিকে ইউরোপে বেকারত্ব ভাতা থাকলেও কর্মী ছাঁটায় না করার শর্তে নিয়োগকারীদের আর্থিক সহায়তা প্রধান করা হয়। ফলে করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বেড়ে যায় কয়েকগুণ। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য, জার্মান ও ফ্রান্সের মতো দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি হার খুবই কম।

অনুন্নত ও আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের শিল্প ও রপ্তানি খাত লকডাউনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদন বন্ধ বা হ্রাস পাওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হয় শ্রমজীবী মানুষ। টিকে থাকার প্রশ্নে শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয় অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ে অনেক মানুষ। তাছাড়া বাংলাদেশের মোট কর্মজীবী মানুষের সিংহভাগ অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। যেখানে কর্মের স্থায়িত্বের কোনো গ্যারান্টি নেই। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে স্বনিয়োজিত কর্মীরাও বিপাকে পড়ে লকডাউনে, অনেকে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষিত বেকার সংখ্যা ও লকডাউন প্রজন্ম (লকডাউন বা অনান্য যেকোনো কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার সময় যে প্রজন্ম শ্রমবাজারে প্রবেশের কথা কিন্তু কর্মসংস্থানের সংকটের ফলে প্রবেশ করতে পারছে না তারা) বৃদ্ধি পায়। গবেষণার তথ্যমতে, এ ধরনের প্রজন্ম যারা কর্মজীবনের প্রথম ধাপেই বাধার সম্মুখীন হয়, তাদের এই আঘাত কর্মজীবনে স্থায়ী হওয়ার ভয় থাকে। করোনার ফলে নতুন করে দারিদ্র্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া আমরা যাদের দারিদ্র্যের তালিকার বাইরে বিবেচনা করতাম তাদের মোট সংখ্যার সিংভাগের অবস্থান ছিল দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে। ফলে লকডাউনের ফলে সৃষ্ট সংকটের ফলে কর্ম হারিয়ে বা আয় কমার ফলে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসে।

তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী দারিদ্র্য রেখা ১০ শতাংশ ওপরে উঠিয়ে দিলে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য সংখ্যা বেড়ে যায় ২৯ শতাংশ আর শহর অঞ্চলে বাড়ে ৩৩ শতাংশ (সূত্র : করোনাঘাতে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার, রিজওয়ানুল ইসলাম, পৃ; ৪৯)। বাংলাদেশ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বর্তমানে রেমিট্যান্সের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ জমা হয়েছে। তাছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ফলে পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা বৃষ্টি পেয়েছে; যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে করছে সমৃদ্ধ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মার্চ অবধি ১ লাখ ৮১ হাজার ২১৮ জনের প্রবাসে কর্মসংস্থান হয়েছিল (সূত্র : করোনাঘাতে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার, রিজওয়ানুল ইসলাম, পৃ; ৭৪)। যা দেশের অর্থনীতির জন্য আশার সংবাদ। কিন্তু মহামারির ফলে দেশগুলো সংকটে পড়ে। আর ওই দেশগুলো সংকট নিরসনে তাদের দেশের অবস্থারত বিদেশি শ্রমিকদের প্রথমে ছাঁটাই করে। ফলে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ফলে কর্মহীনদের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। কর্মহীনতা ও দরিদ্রতা মানুষের আয় কমিয়ে দেয়, আর আয় কমার ফলে সামগ্রিক ভোগপ্রবণতা, চাহিদা পক্ষান্তরে সামগ্রিক উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

এদিকে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার ফলে কর্মসংস্থান বা শ্রমের সুযোগও হ্রাস পায়। অর্থনীতির সব সূচকে বাংলাদেশের আশানুরূপ সাফল্য হলেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান বাড়েনি। তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রতি ১ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়েছিল ০.৫৪৯৯ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত জিডিপি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এই হার কমে ০.২৭৫৫ শতাংশে নেমে যায় (করোনাঘাতে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার : রিজওয়ানুল ইসলাম; পৃ : ৫০)। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় কর্মসংস্থানের হার অনেক কম। আর এই ধরনের প্রবৃদ্ধিকে ‘কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি’ বলা চলে। ওপরের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দ্বারা এটা নিশ্চিতভাবে বলা চলে, করোনা মহামারির ফলে বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রকাশ্য সংকোট চলছে। এমতাবস্থায় এই সংকট নিরসনে দ্রুত স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরে আসতে হবে অর্থাৎ শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি করতে হবে। শ্রমের চাহিদা যত দ্রুত বৃদ্ধি পাবে, তত দ্রুত এই সংকট কেটে যাবে। শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি জন্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। আর উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য অনুৎপাদন খাত পরিহার করে উৎপাদন বিনিয়োগে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, অর্থনৈতিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত হলো নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি ও শ্রমশক্তিকে উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে নিয়োগ করা।

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close