বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনা
নেতানিয়াহু যুগের অবসান ও ফিলিস্তিন সংকট
ইসরায়েলে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পতন হয়েছে। ইরানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব কিংবা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার কারণে সারা বছরই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তিনি ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কট্টর এই ইহুদি নেতার গদি হারানোর পর ইসরায়েল নতুন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীও কট্টর ফিলিস্তিনবিরোধী বলে সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর বেরিয়েছে। এতে ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানের আশা ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কলামিস্টদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. জামিন আহমদ।
নতুন সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা
ডানপন্থি, মধ্যমপন্থি, বামপন্থি, এমনকি একটি আরব মুসলিম দলসহ ৮ দলের সমন্বয়ে ইসরায়েলের নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, যা বিবেচিত হচ্ছে নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে। আদর্শগত অনেক অমিল থাকা সত্ত্বেও লিকুদ পার্টির নেতা এবং এক যুগ ক্ষমতায় থাকা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ব্যাপারে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে। সদ্য শেষ হওয়া গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার পর নতুন এ সরকার গঠিত হওয়ায়, সংগত কারণেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি এ সরকারের আচরণ কেমন হবে বা ফিলিস্তিনি সংকট নিরসনে আদৌ কোনো অগ্রগতি হবে কি না এটার দিকে সবার নজর রয়েছে। ৭২ বছর ধরে যতগুলো সরকারই ইসরায়েলের ক্ষমতায় এসেছে তাদের প্রত্যেকের নীতি আদর্শ বলতে গেলে একই ছিল। এদিকে এ সরকার আদৌ চার বছর পার করতে পারবে কি না তা নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। তার কারণ দলগুলোর আদর্শগত ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ইয়ার লাপিদ এবং নাফতালি বেনেট এই দুই নেতা দুই বছর করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রথম দুই বছর প্রধান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন কট্টর ডানপন্থি নেতা নাফতালি বেনেট। নাফতালি বেনেট কতটা ফিলিস্তিনবিদ্বেষী তা তার একাধিক বক্তব্যে স্পষ্ট। ২০১৩ সালে একবার মন্তব্য করেছিলেন ‘বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি নয়, বরং হত্যা করা উচিত।’ ইসরায়েলের উচিত গাজা ও পশ্চিমতীর দখল করে নেওয়া। মাত্র ছয় আসন থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার ভাগাভাগিতে দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্ব পাচ্ছেন। এখানে একটা বিষয় খুবই উল্লেখ করার মতো। সেটি হচ্ছে, এটা যেহেতু জোট সরকার আর এখানে অনেকগুলো দল রয়েছে। সুতরাং কোনো দলই নিজের দলের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তাহলে ঐক্যে ফাটল ধরবে আর সেই সুযোগটিই নিতে চান নেতানিয়াহু। নেসেটে সর্বোচ্চ আসন পাওয়া লিকুদ পার্টিকে হয়তো সে সুযোগ আপাতত দিতে চাইবে না নতুন সরকার। মোদ্দা কথা, ইসরায়েলি নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
মো. শহীদুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, ইসলামী ইতিহাস ও
সংস্কৃতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফিলিস্তিন সংকট জিইয়ে রাখা হবে আত্মঘাতী
নিজের ক্ষমতা বাঁচানোর জন্য চেষ্টার কমতি রাখেননি নেতানিয়াহু। ফিলিস্তিনে সাম্প্রতিক সময়ে যে নারকীয় হত্যাকা- চালানো হয়েছে, তার মূলে ছিল নেতানিয়াহুর ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার তীব্র অভিপ্রায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ফিলিস্তিনি শিশুদের গগনবিদারি আর্তনাদ যেন অভিশাপ রূপে হানা দিয়েছে নেতানিয়াহুর মসনদে। ১২ বছর ধরে কুক্ষিগত করে রাখা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছে নেতানিয়াহুকে। ইসরায়েলে জোট সরকার গঠনের জন্য সম্মত হয়েছেন ইয়ার লাপিদ ও লাপতালি বেনেট। নতুন সরকার গঠনকে ঘিরে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন অনেকে। সাধারণ মানুষের ধারণা স্থায়ী সমাধানে না পৌঁছালেও ফিলিস্তিন ইস্যুকে ঘিরে কার্যকর কোনো সাময়িক সমাধান প্রদানে সচেষ্ট হবে নবনির্বাচিত সরকার। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে অবধারিতভাবেই বলা যায়, সরকার পরিবর্তন হলেও ইসরায়েলিদের নীতির কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন সমস্যাকে জিইয়ে রাখার পেছনে ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এত সহজেই এ সমস্যার কাক্সিক্ষত সমাধান সম্ভব নয়। তবে আমরা আশা রাখতেই পারি, নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের পথে নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের জন্য স্থায়ী রাষ্ট্রের সর্বজনীন স্বীকৃতি মিলতে আরো কত রক্তাক্ত প্রান্তর দেখতে হবে?
ফারহান ইশরাক
শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মুসলিম সংগঠন, জাতিসংঘ ও আমেরিকার ভূমিকাই মুখ্য
গত দুবছরে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু নেতানিয়াহুকে অপসারণ করা যায়নি। সম্প্রতি বিরোধী দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে অবসান ঘটেছে নেতানিয়াহু যুগের। একযুগ ক্ষমতায় থেকে সম্প্রসারণবাদী নীতিতে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করেছে তার সরকার। মার্কিন মদদপুষ্ট হয়ে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং যুদ্ধপরাধ দুটোই হয়েছে তার আমলে। কিন্তু কোনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। বস্তুত, নেতানিয়াহু যুগের অবসান ঘটলেও ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান শিগগিরই হচ্ছে না। যেখানে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন নাফতালি বেনেটের মতো ব্যক্তি। যিনি নেতানিয়াহুর চেয়েও কট্টরপন্থি। দায়িত্ব নেওয়ার পর আগ্রাসী হলে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিন সংকটের সুরাহার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ১৯৭৪ সালে গোল্ড মায়ারের কাছ থেকে ইতজাক রাবিন ক্ষমতা নিয়ে প্রথম মেয়াদে আগ্রাসী থাকলেও ইহুদিদের কাছে ভালো ছিলেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে ক্ষমতায় এসে ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে এলো চুক্তি করলে (৯৩) চরমপন্থিরা তাকে হত্যা করে। তাই কোনো প্রধানমন্ত্রী চাইলেও এই সংকটের ইতি ঘটবে, তার বিশ্বাস করা দুরূহ ব্যাপার। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে আলোচনার ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্র সমাধানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু আমেরিকা ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ দেখে না। ইসরায়েলি পুলিশের গুলিতে যখন শত শত ফিলিস্তিনি শাহাদতবরণ করে, মিসাইল হামলায় যখন আকাশচুম্বী ভবনগুলো নিমেষেই ধসে পড়ে তখনো বাইডেন-ব্লিংকেনরা ইসরায়েলের পক্ষেই সাফাই গায়। এ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে সংকট সমাধানে মুসলিম সংগঠন, জাতিসংঘ এবং আমেরিকাকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায়, তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরকালই জরাজীর্ণ থেকে যাবে। সংকট রূপ নেবে মানবিক বিপর্যয়ে।
সাইফুল ইসলাম হাফিজ
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধে চাই আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
রাজা যায় রাজা আসে তবু হয় না নীতির পরিবর্তন। এই বাক্যটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমন সত্য একইভাবে সত্য দখলদার ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও। ইসরায়েল অভিবাসী হয়ে আরব ভূমিতে প্রবেশ করে এখন আরব রাষ্ট্রগুলোকে নাকে খত দিয়ে নাচাচ্ছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, আরব ভূখ-ে যত গোলযোগ সৃষ্টি হয় তার পেছনে সব সময় ইসরায়েলের হাত থাকে। ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের ১১ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতি হয়েছে কদিন আগে। এই যুদ্ধের পেছনের মূলহোতা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই মূলত ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে আগ্রাসন চালানো শুরু করে নেতানিয়াহু সরকার। ২০০৯ সাল থেকে টানা ১২ বছরের ক্ষমতার ইতি টানতে হচ্ছে দখলদার নেতানিয়াহুকে। বছরজুড়ে তিন দফা নির্বাচন করেও সরকার গঠনের মতো আসনে জয় লাভ করতে পারেনি নিয়াহু। এদিকে ইসরায়েলে নতুন জোট সরকার গঠন করার জন্য ঐকমত্যে পৌঁছেছেন ইয়ার লাপিদ ও লাপতালি বেনেট। বেনেট আরবপন্থি হলেও ইসরায়েলের স্বার্থ বাদ দিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাবে না। তাই সত্যটা এই যে, ইসরায়েলে রাজার পরিবর্তন হলেও নীতির পরিবর্তন হবে না।
সাইফুল বিন শরীফ
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
সংকট সমাধানের আশা ক্ষীণ
নেতানিয়াহুর বিদায় ও ফিলিস্তিন সংকট অবশেষে দীর্ঘ ১২ বছর পরে ইসরায়েলে শেষ হতে যাচ্ছে নেতানিয়াহুর শাসনকাল। পরপর চারটি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয় বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি। প্রধানমন্ত্রীর মসনদে আরো একবার বসার প্রত্যাশায় তিনি জোট গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কট্টর ডানপন্থি নেতা বেনেট
নাফতালিকে। কিন্তু নেতানিয়াহুর এক সময়ের চিফ অব স্টাফ বেনেট নাফতালি জোট গড়েন মধ্যপন্থি দল ইয়েস
আতিদ পার্টির সঙ্গে। এর ফলে আগামী দুই বছরের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন নাফতালি এবং পরবর্তী দুই বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন
ইয়েস আতিদ পার্টির নেতা ইয়াইর লাপিদ। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েলে সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যের আদৌ কোনো পরিবর্তন ঘটে কি না। নেতানিয়াহুর থেকেও আরো বেশি কট্টরপন্থি, ইহুদিবাদী নেতা বেনেটের শাসনামলে ফিলিস্তিনিদের জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে এ কথা আসলে কেউই বলবে না। বেনেটের মতে, ‘পশ্চিমতীর অধিকৃত নয়, কারণ এখানে কখনো ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র ছিল না।’ তাই বেনেটের দুই বছরের শাসনামলে অসহায় ফিলিস্তিনিদের জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে না বলেই মনে হচ্ছে।
আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা
শিক্ষার্থী, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
"