আরমান শেখ
মুক্তমত
লিবিয়ার এক দশক ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এক দশক ধরে চলমান গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আরব বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি রাষ্ট্র লিবিয়া। আরব বসন্তের মোহে মাতাল হওয়া আজকের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি দশ বছর আগেও সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় ছিল। কিন্তু সেই তেলসমৃদ্ধ দেশে আজ হাঁটতে গেলেই পায়ের নিচে পড়ে বোমা-মাইন, বাতাসে গোলাবারুদের গন্ধ। বর্তমানের বসবাস অযোগ্য যুদ্ধপ্রবণ এ রাষ্ট্রটিতে ১৯৫০ সালে খনিজ তেল আবিষ্কার হয়। এরপর ধীরে ধীরে লিবিয়া পরিণত হয় আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটিতে।
১৯৫১ সালের ২৪ ডিসেম্বর দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে একটি স্বাধীন রাজতন্ত্রে পরিণত হয়। এরপর ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কর্নেল গাদ্দাফি এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। এই তরুণ শাসক সমাজতন্ত্র ও আরব জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী এক নতুন লিবিয়া গঠন করেন। গাদ্দাফির সময়োপযোগী শাসনব্যবস্থার ফলে লিবিয়ার বেকারত্ব শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, লিবিয়া পরিণত হয় আফ্রিকার সর্বোচ্চ জিডিপির দেশে। কিন্তু সময়ের আবর্তনে গণতান্ত্রিক শাসনটি বহির্বিশ্বে সামরিক একনায়কতন্ত্র হিসেবেই বেশি পরিচিতি লাভ করে। আর এই পরিচিতি দেওয়ার পেছনে সর্বাধিক ভূমিকা ছিল স্বার্থান্বেষী পশ্চিমা মহলের।
আশির দশকে চিলি, কলম্বিয়ায় যা হয়েছিল, বিংশ শতকেও আরব বিশ্বে তার ধারাবাহিকতা দেখতে পেল বিশ্ববাসী। পশ্চিমাদের শত্রুর তালিকায় পরিবর্তন এলো। তাদের হিট লিস্টে মতাদর্শগত পরিবর্তন এলো, সমাজবাদের পরিবর্তে এলো ইসলামি মৌলবাদ। আরব বসন্তের ঝড়ো বাতাসের ফাঁদে পশ্চিমারা একে একে শিকার করে নিল ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়াকে। মিথ্যা সমতার গল্প আর রঙিন দুনিয়ার লোভ দেখিয়ে তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার স্বাধীনতা, শান্তি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হলো।
আফ্রিকার শীর্ষস্থানীয় ধনী দেশটির পূর্বাঞ্চলে কয়েক দশকব্যাপী বিদ্রোহীদের একত্র করছিল সিআইএ এবং এম-সিক্সটিন। এ ছাড়া আশির দশকে গাদ্দাফির সঙ্গে মতবিরোধের জেরে ভার্জিনিয়া পালিয়ে যাওয়ার সময় জেনারেল হাফতারকেও হাত করে সিআইএ। ফলে ২০১১ সালে লিবিয়ায় বিদ্রোহ সংঘটন সহজ হয়। হাফতারকে নিয়োগ দেওয়া হয় বিদ্রোহী বাহিনীর প্রধান হিসেবে। ২০১১ সালে ন্যাটোর লিবিয়া আক্রমণের পেছনে সর্বাধিক ইন্ধন ছিল ফ্রান্সের। তারাই জাতিসংঘে ‘রেজল্যুশন ১৯৭৩’ পাশের কয়েক ঘণ্টার মাথায় সর্বপ্রথম ‘অপারেশন ইউনিফাইড প্রটেক্টর’ পরিচালনা করেছিল। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, ফরাসি বিমানগুলো লিবিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল রেজল্যুশনটি পাস হওয়ার চার ঘণ্টা আগেই। এই অত্যুৎসাহের অন্যতম কারণ ছিল তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্টের অধপতিত জনপ্রিয়তার উন্নয়ন, আঞ্চলিক রাজনীতিতে সক্রিয়তা বৃদ্ধি, অস্ত্র বাজার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কারণ হলো, ক্ষমতায় যেতে গাদ্দাফি থেকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির অর্থ নেওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া। ২০০৭ সালের নির্বাচনে ৫০ মিলিয়ন ইউরো নেওয়ার ঘটনায় ফ্রান্সের আদালতে এখনো মামলা চলছে। আগ্রাসীদের এসব স্বার্থের কথা জেনেই ন্যাটোর অভিযান শুরুর পর গাদ্দাফি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র না, ওরা আমাদের তেল চুরি করতে এসেছে’। সত্যই গাদ্দাফি হত্যা ৪২ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি টানলেও রক্তারক্তির ইতি টানতে পারেনি।
গাদ্দাফির মৃত্যুর পর ২০১২ এবং ২০১৩ সালে লিবিয়ার পরিস্থিতি মোটামুটি ভালোই ছিল। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ পুরোপুরি সিদ্ধি না হওয়ায় ২০১৪ সালে জেনারেল হাফতারের মাধ্যমে আবার আগ্রাসন শুরু হয়। গাদ্দাফি-পরবর্তী যুগে নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষিত করতে লিবিয়াকে পরিণত করা হয় আন্তর্জাতিক ছায়াযুদ্ধের দাবার ঘুঁটিতে। অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক ২০১৪ সালের দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধকে ইসলামপন্থি এবং ইসলামবিরোধীদের সংঘর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু দ্বন্দ্বটি ছিল মূলত সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে স্বৈরতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে চাওয়া শক্তির। বিভিন্ন কারণে ইসলামপন্থিদের অনেকেই সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে যোগ দেয় আর তাদের দমন করতে গিয়ে সামরিকতন্ত্রকামী শক্তি ইসলামবিরোধীদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মূল দ্বন্দ্ব ধর্মকেন্দ্রিক নয়, ধর্ম এখানে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অনুষঙ্গ ছিল মাত্র।
২০১৯ সালে দেশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে রাজধানী ত্রিপলিত অভিযানের প্রস্তুতি নেয় বিদ্রোহী বাহিনী। ঠিক ওই সময় লিবিয়ায় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত তুর্কি পার্লামেন্টে ৩২৫-১৮৪ ভোটে পাস হয়। ‘বৈধ সরকারকে সমর্থন এবং একটি মানবিক ট্র্যাজেডি এড়াতে’ তুরস্ক সামরিক হস্তক্ষেপ করে। লিবিয়ায় এই তুর্কি সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল সিরিয়া, ইরাকের তুলনায় যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সব ঝুঁকি বাজিমাত করে তুরস্কের গোয়েন্দা বাহিনী এবং কিলার ড্রোন হাফতারের বাহিনীকে ত্রিপলির উপকূল থেকে তাড়িয়ে ৪৫০ কিলমিটার আগে সির্তে? শহর পর্যন্ত নিয়ে যায়। গত বছরের ঠিক এ সময়ে আঙ্কারার ড্রোন বৃষ্টি হাফতার এবং তার আন্তর্জাতিক সঙ্গীদের আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করে। অর্থনৈতিক স্বার্থেই লড়াইকে যুদ্ধের ময়দান থেকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে সবপক্ষ। তবে দশ বছরের যুদ্ধে প্রকৃত অর্থে পশ্চিমাদের তেমন কোনো ফায়দা হয়নি। সাদ্দামকে হটিয়ে যেমন ইরাককে কার্যত ইরানের হাতে তুলে দিল আমেরিকা, ঠিক তেমনি গাদ্দাফিকে হত্যা করে লিবিয়াকে কার্যত রাশিয়া এবং তুরস্কের আয়ত্তে দিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন।
একাধিক সমঝোতার পর মার্কিন সমর্থন আর চাপে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এ বছরের ১০ মার্চ লিবিয়ায় একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং নিরপেক্ষ বলে ধারণা করা হচ্ছে। শর্ত অনুযায়ী এই সরকারকে আগামী ২৪ ডিসেম্বর নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষক মহল এখন সরগরম। প্রথমত, লিবিয়া-তুরস্ক সমুদ্র চুক্তির প্রতি নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তিটি বিশ্বাঙ্গনে এরদোয়ানের বিগত এক দশকের সর্বাধিক বিচক্ষণ চাল হিসেবে বিবেচিত। এরই মধ্যে এই চুক্তি বহাল থাকার কথা বলেছে ঐকমত্যের সরকার। এ ছাড়া সম্প্রতি তুর্কি-মিসর সম্পর্কেরও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। মিসর এরই মধ্যে তুর্কি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্বীকার (অনানুষ্ঠানিকভাবে) করে নিয়েছে। ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ইসরায়েলি জোটের স্বাক্ষরিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি অনেকটা অকেজো হয়ে পড়েছে। অনেকের মতে, লিবিয়ায় যুদ্ধ থামাতে নয়, বরং এই চুক্তি বহালের তাগিদেই ত্রিপোলিতে তুর্কি সৈন্যের অবস্থান।
স্বভাবতই ফ্রান্স-রাশিয়া জোটের কাছে ঐকমত্যের সরকারের আংকারাপ্রীতি কাম্য নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরপর ১৫ জন মন্ত্রী সহকারে সরকার প্রধানের তুরস্ক সফর অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ছিল সবার কাছেই। সফরে আগের চুক্তিসমূহ বজায় থাকবে জানালেও লিবিয়ায় তুর্কি সেনা থাকার বিরোধিতা করেছে মানফি-দাবিবেহ সরকার। এতে বোঝা যাচ্ছে, এই সরকার অন্ধভাবে তুর্কি দাবি পূরণ করবে না, বরং স্বকীয় অবস্থান বজায় রাখবে। আর এই স্বকীয়তার ওপরই নির্ভর করছে লিবিয়ার ভবিষ্যৎ। আর লিবীয় পরিস্থিতিই নির্ধারণ করবে আগামীর ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাসের মালিকানা ও তুর্কি-কাতার বলয়ের ভবিষ্যৎ।
পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে লিবিয়ার স্থায়ী শান্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা আর কিছু শর্তের ওপর নির্ভরশীল। আসন্ন নির্বাচনে সরাসরি আংকারা কিংবা ব্রাদারহুড সমর্থিত প্রার্থী জয় লাভ করলে ফ্রান্স-সৌদি-রাশিয়া মেনে নেবে না। ফলে ২০০৭-এর হামাস ও ২০১৩-এর মিসরে ব্রাদারহুডের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। নতুন করে গৃহযুদ্ধ উসকে দেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে কট্টরবিরোধী কেউ ক্ষমতায় এলে সব তুর্কি প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তুর্কি কোম্পানিগুলোর ৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, চুক্তি, লিবিয়া পুনর্গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন; সবকিছুই নস্যাৎ হবে। এ ছাড়া উত্তর আফ্রিকা থেকে তুর্কি-কাতার বলয়ের রাজনৈতিক প্রভাবের প্রস্থান ঘটবে। ফলে তুর্কিদের জন্য আফ্রিকা প্রবেশের ইচ্ছা স্বপ্নই রয়ে যাবে। তাই লিবিয়ার পাশাপাশি আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়াকে সৌদি বলয় থেকে রক্ষা করতে এরদোয়ান ও ব্রাদারহুড সমঝোতা করে পরোক্ষ প্রার্থী দিতে পারে। এভাবেও নির্বাচন-পরবর্তী স্থিতিশীলতা রক্ষা হতে পারে।
আজ প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধে আসল পরাজিত লিবিয়ার জনগণ। গাদ্দাফি-পরবর্তী প্রজন্ম সন্ত্রাস আর অনিশ্চয়তার মধ্যে বেড়ে উঠছে। বেকারত্ব ঘুচাতে তারা যাচ্ছে মিলিশিয়া গোষ্ঠীতে, হাতে তুলে নিচ্ছে খাতা-কলমের পরিবর্তে সমরাস্ত্র। মানসিক বিকাশ হচ্ছে নৃশংস পরিবেশে। ইউরোপে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে লিবিয়ার নতুন প্রজন্মের একটি অংশ। ইরাকিদের মতোই, পশ্চিমা মদদে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মাঠে নামা লিবীয় সমাজ আজ গাদ্দাফির জমানায় ফিরে যেতে চাইছে। এতে ন্যাটোর বোমাবর্ষণের শিকার ৩৫ হাজার জীবন, দুই লাখ লোকের ঘরবাড়ি, ন্যাটো সমর্থক মিলিশিয়াদের লুটে নেওয়া গাদ্দাফির ‘স্টেট-অ্যাসেট’ ৩৬০ বিলিয়ন ডলার হয়তো ফিরে আসবে না আর। তবু লিবীয়রা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের আশায় বুক বাঁধছে নতুন সরকারের দিকে তাকিয়ে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের কল্যাণে লিবিয়ার নতুন নেতৃত্বকে অবশ্যই নিরপেক্ষ কূটনীতি পরিচালনা করতে হবে। আর শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা। তাই অবকাঠামো নির্মাণ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অতি সত্তর নয়া সরকারকে কাজ শুরু করতে হবে।
লেখক : নিবন্ধক ও কলামিস্ট
"