মো. জিল্লুর রহমান

  ১০ মে, ২০২১

আলোচনা

সততার সঙ্গে কৃষকের পাশে দাঁড়ান

কৃষি এ দেশের অর্থনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত। বর্তমানে দেশে জিডিপির প্রায় এক পঞ্চমাংশ অর্জিত হয় কৃষি খাত থেকে। তার চেয়েও বড় কথা কৃষি এ দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির প্রধানতম এবং অন্যতম উৎস। শুধু তা-ই নয়, শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামালও এ কৃষি থেকেই জোগান দেওয়া হয়। এখনো এ দেশের বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানও হয়ে থাকে কৃষিকে অবলম্বন করেই। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, জীবনযাত্রায় মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে কৃষিক্ষেত্রে যে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে এবং মনে রাখতে হবে এর কোনো বিকল্প নেই।

টানা ৮ মাস অনাবৃষ্টি, কালবৈশাখীর ঝাপটা, লবণাক্ততা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বোরো আবাদ চাষির খুব অনুকূলে ছিল না। তবু বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে বোরো ধানের সোনালি শিষ স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষক পরিবারকে। দাবদাহের মধ্যে পাকা ধান দুলছে বাতাসে। এ অবস্থায় চাষিরা তাই রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ধান কাটা উৎসব শুরু করেছেন। গত বছরগুলোতে বোরো মৌসুমে বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এবার বীজতলা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা মেলেনি। পুরো মৌসুমই সেচের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। তার পরও ধানের ফলন ভালো হয়েছে।

এপ্রিল-মে মাস দেশের বোরোচাষিদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। পাকা বোরো ধান এ সময় মাঠে দুলদুল করে হাওয়ায় দোলায়। কৃষকের মনে সোনালি স্বপ্ন চিকচিক করে। সময়মতো হাওরের পাকা ধান কাটতে না পারলে মাটিতে মিশে যায়। কারণ ধান কাটার জন্য উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিশ্রমিকরা এ সময় হাওর এলাকায় যেতে পারছে না। বোরো কাটার পর আউশ, আমন ও পাট বোনা হবে কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে চাষির সব হিসাবনিকাশ ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই এ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তবে এ দেশের কৃষির বেহাল দশা এখনো বিদ্যমান। তাই এ দেশের কৃষির উন্নয়নে কৃষির আধুনিকায়ন খুবই জরুরি। কৃষির আধুনিকীকরণ বলতে কৃষির সর্বক্ষেত্রে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগকে বোঝায়। কিন্তু বিশ্ব এগিয়ে গেলেও আমাদের দেশের কৃষকরা পেছনে পড়ে রয়েছে। তারা নানা ধরনের সমস্যার বেড়াজালে আটকে রয়েছে। তারা বাপ-দাদার আমলের পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করছেন। তারা যথেষ্ট পরিশ্রমী হলেও প্রযুক্তির ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার কারণে এগিয়ে যেতে পারছেন না।

আধুনিক কৃষিযন্ত্র দিয়ে ধান কাটার প্রক্রিয়া অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী। একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টর মেশিন দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ বিঘা জমির ধান কাটা, মাড়াই, পরিষ্কার ও বস্তাভর্তি করা সম্ভব। অন্যদিকে রিপার মেশিনের মাধ্যমে ঘণ্টায় দুই বিঘা জমির ধান কাটা যায়। এতে ৯০ ভাগ খরচ সাশ্রয় হয়। যদি সরকারি উদ্যোগে সহজশর্তে কৃষকদের মধ্যে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র কম্বাইন্ড হারভেস্টর ও রিপার মেশিন বিতরণ করা যায়, তবে কৃষকের শ্রমিক বিড়ম্বনা আর থাকবে না।

তবে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঠপর্যায়ের কর্মচারীরা অভিযোগ করছেন, অনেক স্থানে কৃষিযন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তা ঠিক করতে সময়মতো কৃষকের অনুরোধে তারা যেতে পারছেন না। কারণ, করোনা ভাইরাসজনিত লকডাউনের কারণে অনেক স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের যেতে দিচ্ছে না। তাদের বলা হচ্ছে, তারা নাকি খাদ্য পরিবহন ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নয়। তবে কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কৃষি যন্ত্রপাতি ও কারিগররা কৃষি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে তাদের চলাচলকে নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রাখতে হবে।

আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকলেও গত বছরের মতো এ বছরও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এজন্য কৃষকের মুখে হাসি। কিন্তু গত বছরের মতো করোনাভাইরাসের কারণে এ বছরও ধান কাটার শ্রমিক সংকট দেখা দেওয়ায় মহাচিন্তায় পড়েছে কৃষক। সাধারণত শ্রমিকরা দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে ধান কেটে থাকেন। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সরকার লকডাউন ঘোষণা করায় দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ রয়েছে এবং এ কারণে দূরদূরান্তের শ্রমিকরা ধান কাটায় অংশ নিতে পারছেন না। এ ছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থায় খেতের পাকা ধান নিয়ে অনেক কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। অবশ্য সরকারের উদ্যোগ সীমিতসংখ্যক শ্রমিক বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ধান কাটা শুরু করেছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। দূরপাল্লার পরিবহনব্যবস্থা বন্ধ থাকায় ব্যাপক হারে শ্রমিকরা ধান কাটায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।

তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক সংকটে পড়া কৃষকদের ধান কাটতে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী, প্রশাসনের লোকজন, স্বেচ্ছাসেবী ও জনপ্রতিনিধিরা। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয় ও ভালো উদ্যোগ। কিন্তু গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে, অনেকে ধান কাটার চেয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দেওয়ায় বেশি সক্রিয়। অনেকে দলবলসহ সিনেমার শুটিংয়ের মতো ছবি তোলায় মহাব্যস্ত, আবার অনেকে কাঁচা ধান কেটে ছবি তুলছে, এতে কৃষকের উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। মনে হয় যেন অনেকে তারকা খ্যাতির প্রতিযোগিতায় মাঠে নেমেছে। তা ছাড়া, এটা খুবই দুঃখজনক ও কৃষকের সঙ্গে এক ধরনের তামাশা। যদি স্বেচ্ছাশ্রমে সম্ভব না হয়, তবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কৃষকের ধান কাটায় সহযোগিতা করুন কিন্তু ফটোসেশনের নামে সোশ্যাল মিডিয়া গরম করা কৃষকের সঙ্গে এক ধরনের তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা বন্ধ করে কৃষকের ধান কাটায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন, এতে কৃষক উপকৃত হবেন, দেশও অনেক উপকৃত হবে। আসুন ছবি তুলে নয়, আমরা সহযোগিতার হাত নিয়ে ধান কাটায় কৃষকের পাশে দাঁড়াই। দেশ বাঁচুক, কৃষক বাঁচুক।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close