সাদিয়া ইসলাম সম্পা

  ১০ মে, ২০২১

দৃষ্টিপাত

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে

একটি দেশ সমাজসভ্যতা সংস্কৃতি সবকিছুর মূলে যে বিষয়টি মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে তা হলো শিক্ষা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোনো দেশের কথাই বলি না কেন প্রত্যেকটি দেশ জাতির টিকে থাকা, উন্নতি লাভ করা সব কিছু নির্ভর করে সে জাতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। যে দেশ বা জাতি নিজেদের যত শিক্ষিত করে কাজে লাগাতে পেরেছে সে জাতি দেশ তত বেশি উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে। একটি জাতি দেশসভ্যতার উত্তরণের পেছনে রয়েছে শিক্ষা। আর তাই শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়কে নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষা খাত নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষা খাতের সংকট ও উত্তরণের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা খাতে রয়েছে অনেক সমস্যা অনেক প্রতিবন্ধকতা, যার ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একটি অসুস্থ ব্যবস্থা হিসেবে পরিণত হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে শিক্ষা খাত। ফলে আমরা যারা শিক্ষার্থী রয়েছি, তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।

প্রাথমিক স্তরে আমাদের যে কোমলমতি শিক্ষার্থী রয়েছে তারা শিক্ষাজীবনের প্রথম থেকেই দোটানা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথম থেকেই তারা পরীক্ষা হবে কি না, স্কুল খুলবে কি না, কবে খুলবে এ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছে বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে। পরিশেষ এ তো তাদের এক্সাম ছাড়াই ওপরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হলো! এই যে প্রাথমিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ছাড়াই ওপরের ক্লাসে উঠে গেল কিন্তু তাদের ওই ক্লাসের পড়া কি আদৌ সম্পূর্ণ হয়েছে কি না কে বলতে পারবে! আবার তারা যে ক্লাসে উঠেছে সে ক্লাসের পড়ার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্য রাখতে পারবে? যেহেতু বিগত ক্লাসে তাদের পড়াটা সম্পন্ন হয়নি। আর তাদের পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাইও করা হয়নি। যে শিক্ষার্থীরা অকৃতকার্য হওয়ার কথা ছিল তারাও ওপরের ক্লাসে উঠে গেছে। এতে করে তাদের মেধার বিকাশের বদলে তাদের ক্ষতি হয়েছে। তারা কি আদৌ কিছু শিখতে পারছে? শিক্ষাজীবনের প্রথম থেকেই একটি দুর্বল শিক্ষাভিত্তির ওপর থেকে তাদের শিক্ষাজীবন শুরু করছে।

প্রাথমিকের পরে মাধ্যমিক এর শিক্ষার্থীদেরও প্রায় একই অবস্থা। তারাও প্রমোশন পেয়ে ওপরের ক্লাসে উঠেছে। এখানেও একই প্রশ্ন। তাদেরও কি প্রাথমিকের মতো সিলেবাস বা বইটি শেষ হয়েছে? তারাও কি আদৌ বাসায় পড়াশোনা করেছে বা কিছু শিখতে পেরেছে? অপরদিকে এ বছরের এসএসসি শিক্ষার্থীদের সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এর ফলে সিলেবাসের কিছু অংশ শিক্ষার্থীদের পড়া হবে আর কিছু অংশ বাকি থেকে যাবে। এতে করে মনে হয় না শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন হচ্ছে। অনেক বিষয়ই তাদের অজানা থেকে যাচ্ছে। পরে তারা যখন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হবে, তখন এসএসসির অনেক বিষয় তাদের থাকবে এবং তা যদি সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের বাইরের টপিক হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের জন্য তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষার্থীদের শেখার থেকে না শেখার অংশই তখন বেশি হবে। আর এতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে সেটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

আবার গত বছর ২০২০ সালে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা এক্সামের জন্য প্রায় কত মাস প্রস্তুতি নিল, পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করল কিন্তু করোনার ভয়াবহ প্রকোপের জন্য শেষমেশ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাটাই নেওয়া হয়নি। তাদের অটোপাস দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এত করে আমার মতে সব থেকে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেননা এইচএসসি পরীক্ষার পরই উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। আর ভর্তির এই প্রক্রিয়া অনেকটা নির্ভর করে এইচএসসির রেজাল্টের ওপর। কারণ এইচএসসির জিপিএ অনেকটা নির্ভর করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সের জন্য। উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ভবিষ্যতের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সমাজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তৈরি হবে। যদি এসব উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে যোগ্য শিক্ষার্থীদের পরিবর্তে অযোগ্য শিক্ষার্থীরা সুযোগ পায় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এটা ভাবার বিষয়।

এদিকে করোনার ভয়াবহ প্রকোপ এসব থেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এদের কেউ চতুর্থ বর্ষে যাদের পরীক্ষা নেওয়া হলেই বের হয়ে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু তারা আটকে আছে। এতে করে তাদের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ছে। এই একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অন্যান্য বর্ষের শিক্ষার্থীরও। যে শিক্ষার্থীরা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে তাদের অবস্থা আরও খারাপ। তাদের অনেকের তো পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে পরিবারের টানাপড়নের কারণে। এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার দরুন অনেকেই সংসারের দায়িত্ব নিয়েছেন নিজের কাঁধে। এর ফলে অনেকেই পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়েছে। এদের অনেকেই তাদের পড়াশোনা শেষ করতে পারবে কি না সেটা নিয়ে রয়েছে সংশয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও রয়েছেন সংকটে। যেসব শিক্ষকরা নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তাদের অনেকের মাসিক বেতন বন্ধ রয়েছে অনেক মাস ধরে। এতে করে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। শিক্ষক হলেন সমাজ গড়ার কারিগর। আর সেই শিক্ষকদেরই যদি এমন কষ্ট হয় জীবিকা নির্বাহ করতে তাহলে সেটা নিদারুণ যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা জানি, শিক্ষকরা মহান পেশার সঙ্গে জড়িত, শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় তারা যদি নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন, তাহলে সেটা সমাজের অবনতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই, শিক্ষা খাতের সংকট নিরসনের জন্য শিক্ষার্থীদের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি শিক্ষকদের সচ্ছলভাবে জীবিকা নির্বাহের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে।

অন্যদিকে আমাদের গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থা অতীতের তুলনায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন হয়েছে। তবে যে পরিবর্তন হয়েছে সেটি শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিরসনের জন্য যথেষ্ট নয় এবং সময়ের সঙ্গে অনেকটাই পিছিয়ে। গ্রামে এখনো সরকারি স্কুলগুলোতে যথাযথভাবে ক্লাস হয়নি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনেকেই ক্লাস পরীক্ষা পড়াশোনার প্রতি উদাসীন। ড্রেস থেকে শুরু করে ক্লাসের ব্যাপারে কোনো মতে বেখেয়ালিভাবে চলছে স্কুলের কার্যক্রম। যেটা কোনোমতে কাম্য নয়। সর্বোপরি আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থার, শিক্ষা খাতের উন্নয়ন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে এক ভয়াবহ অবস্থা পার করছে। শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা খাতের সবকিছুতে সমন্বয়হীনতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা, তারা সময়মতো বের হতে পারছে না, চাকরির বাজারে চাকরি পাচ্ছে না। চাকরির অভাবে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এই করুণ পরিণতি ঠেকাতে প্রথমেই আমাদের শিক্ষিত বেকার তৈরি বন্ধ করতে হবে। সবার জন্য চাকরি নিশ্চিত করতে হবে নতুবা গ্র্যাজুয়েটের পরিমাণ কমাতে হবে। প্রতি বছর এত শিক্ষিত বেকার তৈরি করে কি লাভ যদি না তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা যায়! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে শিক্ষিত বেকারদের আগে চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে, তাহলে দেশে বেকার সমস্যা কিছুটা হলেও নিরসন হবে। শিক্ষা খাত একটি দেশের মেরুদ-। মেরুদ- যদি সোজা না হয় তাহলে দেশে উন্নতি হবে কী করে! তাই দেশের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা খাতের সংকট নিরসন করতে হবে যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে। আর এটাই সরকারের কাছে জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close