রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১০ মে, ২০২১

মুক্তমত

ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

প্রতিটি জাতীয় উৎসব-পর্বে তারা মাটির টানে উৎসে ফিরে যান, স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। গ্রামের সঙ্গে তাদের আত্মিক সম্পর্কটি এখনো অটুট ও অম্লান রয়ে গেছে। এটি আমাদের সামাজিক সংহতিকেও সুদৃঢ় করে। বছরের অন্যান্য সময়ে ছুটিছাঁটা তেমন পাওয়া যায় না বলেই ঈদের সময় অনেক বেশি মানুষ শহর থেকে গ্রামে যান। আবার অনেকে আনন্দ ভ্রমণের জন্যও এ সময়টি বেছে নেন। নানা কারণে আমরা বিদেশি পর্যটকদের তেমন আকৃষ্ট করতে না পারলেও অভ্যন্তরীণ পর্যটন অনেক বেড়েছে। ঈদের সময় কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ দর্শনীয় স্থানগুলো পরিণত হয় জনারণ্যে। এই যে ঈদে মাটির টানে বাড়িফেরা কিংবা আনন্দ ভ্রমণের জন্য বের হওয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর যাত্রাকে নিরাপদ করা সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব। করোনাভাইরাসে স্থবির যখন পুরো জাতি, ঠিক তখন সম্মুখসারির যোদ্ধা হয়ে কর্মহীন মানুষ ও দুস্থদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন দেশের অসংখ্য মানুষ। দেশে যখন অঘোষিত লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন হাজার হাজার দিনভিত্তিক মজুরি দেওয়া মানুষ, তখনই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন অনেকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ বাংলাদেশে প্রথম তার অবস্থান জানান দেয়। চীনের উহান প্রদেশের উবেই শহরে নতুন এই ভাইরাসটির সক্রিয় উপস্থিতি এক বিস্ময়কর চমকও বটে। কারণ শনাক্ত এবং মৃত্যুর ঊর্ধ্বহার বৃহত্তর এশিয়ার এই সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রটিকে সংকটাপন্ন করে দিতে বেশি সময় নেয়নি।

শুধু তা-ই নয়, সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল এই অতিমারির ভয়ংকর দাপট। সংক্রমিত এলাকা উবেই শহরকে চীনের অন্যান্য স্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হলো। চীন সরকারের বিচক্ষণতায় এই মাত্রাতিরিক্ত সংক্রামক ব্যাধিটি দেশের অন্যান্য জায়গায় ছড়াতে পারেনি। এই করোনা মহামারি মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলনের পথকেও অবরুদ্ধতার কঠিন জালে আটকে দেয়। মহামারি আধুনিক বিশ্বে নতুন নয়। পৃথিবীতে যুগে যুগে সময়ের ব্যবধানে এমন মহামারির আক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার দুর্ঘটনা মানুষ বহুবার দেখেছে। সে মাত্রায় অসুস্থ ব্যক্তিকে আলাদাভাবে বিচ্ছিন্ন রেখে সুস্থ মানুষের ভিন্ন কোনো নিরাপত্তার বলয় তৈরি করতে হয়নি। কিন্তু করোনা সুস্থ-অসুস্থ সব মানুষের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করে সহজ মিলনের পথে এক প্রাচীরসম বিঘ্ন তৈরি করেছে, যা তাবৎ বিশ্ব এই দ্বিতীয়বার উপলব্ধি করতে পারল। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হচ্ছে সবাইকে। যারা আক্রান্ত তারা তো বটেই, বাকিরাও নিরাপদ দূরত্বে সুস্থ হয়েও আলাদা হওয়ার নতুন স্বাস্থ্যবিধি সবাইকে হতবাক করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে তার দামও চুকাতে হয়েছে অনেককে। উল্লেখ্য, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এটি একটি উত্তম আহ্বান। পাশাপাশি কার্যকর পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবহন সংগঠন ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

তার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদেরও নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন ও সাবধান থাকা দরকার। আমরা জানি, করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। তাই সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে পুলিশ, ট্রাফিক বিভাগসহ অন্য সংস্থাগুলোকে। শুধু মাস্ক নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার অপরাপর নির্দেশনাগুলোও মেনে চলতে হবে। বাস-রেল এবং লঞ্চে শারীরিক দূরত্ব অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। তবে পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে ঘরমুখী মানুষের সংখ্যা যত কম হয় ততই মঙ্গলজনক হবে। বেঁচে থাকলে ঈদ উদযাপনের সুযোগ আরো থাকবে, তাই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা যায় ততই মঙ্গল। সর্বোপরি ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে হলে ব্যবস্থাপনাগত প্রভূত উৎকর্ষের প্রয়োজন। আবার একুশ সালের মার্চের মাঝামাঝিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশকে আতঙ্কে অস্থির করে তুললে পুনরায় লকডাউনের মতো করুণ পরিস্থিতি নিয়ে আসতে হয়। তবে গতবারের স্থবিরতা চোখে পড়ার মতোই ছিল। এবারের অবরুদ্ধ জীবন ও জীবিকা সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। গত বছরও ঈদের বাজারে বড়, মাঝারি আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হয়েছে। এবারও তারা মহাবিপাকে। ফলে করোনার মহাদুর্বিপাক জনজীবনে যে মারাত্মক ক্রান্তিকালের অবতারণা করে সেটা জাতীয় পর্যায়ের হরেক রকম আনন্দ-উৎসব থেকে ধর্মীয় বিধি পালনেও বাধা সৃষ্টি করে।

মানুষের মিলনযজ্ঞে ব্যবচ্ছেদ তৈরি করতে গিয়ে কোনো অনুষ্ঠানমালাকে উদযাপনের সুযোগ কমে আসছে। ফলে গত বছরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কাল উৎসব-আনন্দের পরিবর্তে ঘরে বসেই এমন সব অবিস্মরণীয় দিন টিভিতে, ভার্চুয়াল জগতে উপভোগ করতে হয়েছে। পরে পহেলা বৈশাখেও বাঙালিকে আবহমানকালের সমৃদ্ধ চেতনা ও সাংস্কৃতিক বোধকে পালন করতে হয় গৃহবন্দি অবস্থায়। পর্যায়ক্রমিকভাবে আসে পবিত্র রমজান মাস। ২০২০ সালে রমজান মাস আমাদের জন্য এক আলাদা মাত্রার বার্তা নিয়ে হাজির হয়। কারণ জামাতে তারাবির নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হয়, ফলে বেশির ভাগ মুসল্লিকে ঘরে বসেই সেই নামাজ আদায় করতে হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত পুরো দুই মাস অবরুদ্ধ দেশের অর্থনীতির চাকা থেকে শুরু করে সামাজিক বলয়ও এক অনাবশ্যক অচলায়তনের বেড়াজালে আটকে যায়। রমজানের মধ্যে ঈদের কেনাকাটায় পড়ে এক অপ্রত্যাশিত বিঘ্নতা। গত বছর তাও কোনোভাবেই উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। মুসলমানদের এই পবিত্র ঈদে মানুষের কোলাকুলির যে রেওয়াজ সেখানেও আসে এক ভয়ানক সামাজিক দূরত্ব। এখন করোনা নিরাময়ের ওষুধই শুধু নয়, প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এক অভানীয় সফলতা। আমাদের বাংলাদেশে করোনার ঊর্ধ্বগতি গত বছর জুন-জুলাই, আগস্ট পর্যন্ত দৃশ্যমান হলেও ক্রমে তা অনেকটা সহনীয় অবস্থায় চলে আসে। ২০২১ সালে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা অনেকটাই নিরাপদ ছিলাম করোনার কবল থেকে।

যখন বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাবল্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নাজেহাল, সে সময়ই বলা হয়, আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান প্রাকৃতিক পরিবেশে যে মাত্রায় সাধারণ মানুষকে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়, সেখানে প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হওয়া সেও প্রকৃতির অবারিত দান। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে খেটে খাওয়া মানুষের উদয়স্ত পরিশ্রমই তাদের ভেতরে এক সুরক্ষিত দুর্গ তৈরি করে দেয়, যা তারা নিজেরাও জানতে পারে না। ফলে দৈনিক খেটে খাওয়া দিনমজুর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে কৃষক শ্রমিকরাও কেমন যেন এই কালব্যাধি থেকে নিরাপদ দূরত্বেই ছিল। তারা যেমন করোনার ভয়াবহতার তোয়াক্কাও করেনি, তেমনি লড়াকু করোনা প্রতিরোধে মনোভাবও বিন্দুমাত্র ক্ষুণœ হয়নি। তবে শহরে-বন্দরে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ আয় কমে যাওয়া থেকে শুরু করে চাকরি হারানোর মতো দুরবস্থায়ও পড়ে যায়। আর যারা খুদে ব্যবসায়ী, ফুটপাতে নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে তাদের রুজি-রোজগারেও আসে এক অশনিসংকেত। সেসব নিম্ন আয়ের খুদে ব্যবসায়ী আজও তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেনি। জনগণ গত বছর থেকে করোনা মোকাবিলা করে কেমন যেন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। শুধু তা-ই নয় দুঃসাহসী এবং বেপরোয়া হওয়ার চিত্র গতবারও দেখা গেছে এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হচ্ছে না। গত বছর ১৭ মার্চ যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হলো নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করতে, তখন অনেক অভিভাবক সন্তানদের নিয়ে সমুদ্র সৈকতে আনন্দ উপভোগ করতে ব্যস্ত ছিলেন।

এবারও টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে আবার সেই একই সমুদ্র বিহারের উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। শুধু তা-ই নয়, সাড়ম্বরে, উৎসব আয়োজনে অনেক বিয়ে অনুষ্ঠানে যে মাত্রায় মানুষের ঢল নামে তাতে আগেই বিশেষজ্ঞরা দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছিলেন। এরই মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার এক ভিন্নমাত্রার বৈশিষ্ট্য রূপান্তরের ভাইরাস নাকি বাংলাদেশকে আক্রান্ত করেছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে তা উঠেও আসে। এবারের ভাইরাস যেমন ছোঁয়াছে একইভাবে প্রাণঘাতীও। ফলে গত বছরের তুলনায় শনাক্তের হার বাড়াবাড়ি হলেও মৃত্যুর হার সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। সিংহভাগ মানুষ যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মবিধিকে অবহেলা আর উপেক্ষায় দূরে সরিয়ে রাখে, তাহলে আইন, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র তাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হবে। প্রত্যেক মানুষ যদি আমরা সচেতন দায়বদ্ধতায় করোনা সংক্রমণকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নিয়মশৃঙ্খলার অধীন হই, তাহলে এই কালব্যাধিটি অবশ্যই পরাভূত হবে। জয়ী আমাদের হতেই হবে। সবকিছুর মধ্যে যা দৃষ্টিকটু তা হলো মানুষের এখনো বোধোদয় হলো না নিজের সুরক্ষাকে নিশ্চিত করতে। এমনকি বাইরের খোলাবাজারে অনেকের মুখে মাক্স পর্যন্ত নেই, সামাজিক দূরত্বকেও কেউ তোয়াক্কা করছে না। মানুষ যদি নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার নিরাপত্তা শুধু সরকারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ঈদের এই আনন্দযাত্রা যাতে বিষাদে রূপ না নেয়, সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close