জান্নাতুন নিসা

  ০৯ মে, ২০২১

দৃষ্টিপাত

কোরআন নাজিলের রাত লাইলাতুল কদর

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে আমাদের অধরা ধৈর্যের শৃঙ্খলিত অনুভূতি স্রষ্টার দানে পূর্ণ হয়েছে বরাবর। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মাস অর্থাৎ প্রতিটি মুহূর্তই মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের দিয়েছেন ভগ্ন সময়ের মগ্ন প্রার্থনায় যুক্ত থাকতে। ভোরের মেঘমল্লার থেকে থেকে শুরু করে রাতের দরজা, যেখানেই তাকাই না কেন আমরা খুঁজে পাই আল্লাহর রহমতের সুবাতাস। তার ভা-ার অনন্ত- অফুরান, তাই তো সৃষ্টির শুরু থেকে আমরা মানবজাতি কেবল নই; সৃষ্টিকুলের প্রত্যেক সৃষ্টিই তার ভালোবাসা নিয়ে বিশ্বভুবনে বিজয়ডঙ্কা বাজিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর আমাদের অপূর্ণতার পেয়ালায় রহমত, বরকত এবং মুক্তির সোপানে অনন্য করে আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা দান করেছেন পূর্ণ একটি মাস, রমজান মাস। রমজান মাস পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস। এই মাসের গুরুত্ব আরো সহস্রগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে আমাদের আখেরি নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, নবীদের ইমাম, রাসুলদের সরদার, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি সবশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব আল কোরআন নাজিলের মাধ্যমে। আর পবিত্র কোরআনের সুরা আল-বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্যদিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ করো এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহতায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।’ লাইলাতুল কদর কোরআন নাজিলের রাত। ৬১০ সালের এ রাতেই মক্কার নুর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট ফেরেশতাদের সরদার হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম কোরআন নাজিল হয়। আল্লাহ লাইলাতুল কদরের রাতকে সব রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের সুরা আদ-দুখানের ২-৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি একে নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, আমিই প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’

আরবি ‘লাইলাতুল কদর’-এর ফারসি পরিভাষা ‘শবেকদর’। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে পবিত্র এই রাত ‘শবেকদর’ নামেই সমধিক পরিচিত। আরবি ‘লাইলাতুল’ শব্দের অর্থ রজনি বা রাত আর ‘শব’ অর্থও রাত। আর কদর অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত, মর্যাদাপূর্ণ, গুণান্বিত, সম্ভাবনাময়, সৌভাগ্যপূর্ণ। সেই সুবাদে লাইলাতুল কদরের অর্থ দাঁড়ায় সম্মানিত রজনি বা মহিমান্বিত রজনি বা রাত। আল্লাহ লাইলাতুল কদরের রাতকে সব রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন, এমনকি হাজার রাতের থেকেও। পবিত্র কোরআনে এ রাতকে প্রশংসার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ নিজেই। আল্লাহ বরকতময় বলে অভিহিত করেছেন এই রাতকে। কারণ এ রাতে রয়েছে যেমন বরকত, তেমনি কল্যাণ ও তাৎপর্য। বরকতের প্রধান কারণ হলো এ রাতে আল-কোরআন নাজিল হয়েছে। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহতায়ালা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সুরা অবতীর্ণ করেছেন। কদরের রাতের ফজিলত ও মহাত্ম সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুরা কদর নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা নাজিল হয়েছে। যেখানে ১-৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে (পবিত্র কোরআনকে) নাজিল করেছি শবেকদরে। শবেকদর সম্বন্ধে আপনি কী জানেন? শবেকদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হন তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ কোরআনের প্রতিটি আয়াতের মতো এই সুরাটিও কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে। এ কথা নিশ্চিত যে আল-কোরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কখন বা কোন রাতে। তবে কোরআনে উল্লিখিত আয়াতের তাৎপর্য পর্যালোচনা করলে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, লাইলাতুল কদর রমজান মাসেই এবং শেষ দশকের কোন রাতেই। আর কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যানুযায়ী তা জোড় রাত অপেক্ষা বেজোড় রাতেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, আবার শেষ দশ দিনের প্রথম বেজোড় রাত অপেক্ষা শেষ দিকের রাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতসমূহে তা খোঁজ করবে।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর : ৭০৯)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘রমজানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর : ১১৬৯)। আর এ রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯।

মহিমান্বিত এই রাতের ক্ষেত্রে অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হলো রমজান মাসের সাতাশ তারিখ। দ্বিতীয় হলো পঁচিশ তারিখ। তৃতীয় হলো উনত্রিশ তারিখ। চতুর্থ হলো একুশ তারিখ। পঞ্চম হলো তেইশ তারিখ। মুহাক্কিকদের মতে, ‘আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে নয়টি হরফ বা আরবি বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে সাতাশ হয়, তাই সাতাশে রমজানের রাতে শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।’ (তাফসিরে মাজহারি)। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো বলেননি যে, ২৭ রমজানের রাত কদরের রাত। তবে ২১ রমজান থেকে নিয়ে ২৯ রমজান পর্যন্ত বেজোড় যে কোনো রাতই শবেকদর হতে পারে, এ কথা নিশ্চিত। একদা হজরত উবায়দা (রা.) নবী করীম (সা.)-কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন নবীজি সেই সাহাবিকে বললেন, ‘রমজানের শেষের দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোকে তালাশ করো।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর : ২০১৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রমজনের শেষ দশ রাতে খোঁজ করে।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর : ৮২৩)। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলেন। এ সময় একবার মাথা বের করে বললেন, ‘আমি কদরের রাত তালাশ করতে গিয়ে প্রথম দশকে এতেকাফ করেছি, অতঃপর মধ্যম দশকেও এতেকাফ করেছি। অতঃপর স্বপ্নে আমার কাছে কেউ এসে বলল কদর রজনি শেষ দশকে। অতএব যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে প্রথম দশকে এতেকাফ করেছে, সে যেন শেষ দশকেও এতেকাফ করে। নিশ্চয় তা আমাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু পরে তা আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে মনে পড়ে আমি ওই রাতের ফজরে নিজেকে পানি আর কাদার মধ্যে সিজদা করতে দেখেছি। অতএব, তোমরা তা শেষ দশকের বেজোড় রাতেই তালাশ করবে।’ আবু সাঈদ (রা.) বলেন, ‘সেই রাতেই আকাশ ভারী বর্ষণ করল। মসজিদ তখন ছাপরা ছিল, অতএব, ছাদ থেকে পানি পড়ল। তখন আমার দুচোখ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখল, যে তার কপালে পানি ও কাদার দাগ লেগেছে। আর তা ছিল একুশ তারিখের সকাল।’ তবে আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের বর্ণনায় রয়েছে ‘তেইশ তারিখের সকাল।’ (বুখারি ও মুসলিম)। এতেকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো শবেকদর প্রাপ্তি; রমজানের শেষ দশক এতেকাফ করলে শবেকদর প্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। এতেকাফের মূল কথা হলো সবকিছু ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়া। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি শরিফ, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ : ২৫, খ- : ১, পৃষ্ঠা ২৯-৩০, হাদিস : ৩৪)। উপরোক্ত হাদিসগুলোর দ্বারা বোঝা যায় শবেকদর প্রত্যেক বছর একই তারিখে হয় না। তবে সব বর্ণনাকারীর একমত রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতেই হয়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি কদরের রাত খুঁজে পাই, তাহলে আমি ওই রাতে কী বলব?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, তুমি বলবে ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে মাজা, সহিহ-আলবানি), (তিরমিজি)। রমজানের শেষ দশকের বেজোড় প্রতিটি রাতকেই লাইলাতুল কদর মনে করতে হবে। তাহলে আশা করা যায়, লাইলাতুল কদর আল্লাহর মেহেরবানিতে হাতছাড়া হবে না ইনশাআল্লাহ।

এ রাতের গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো হলো ১. নফল নামাজ (আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, তওবার নামাজ, সালাতুল হাজাত, সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য) পড়া। ২. নামাজে কিরাত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা। ৩. কোরআন তিলাওয়াত (সুরা কদর, দুখান, মুয্যাম্মিল, মুদ্দাচ্ছির, ইয়া-সিন, ত্ব-হা, আর রহমান ও অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ) করা; ৪. দরুদ শরিফ পড়া; ৫. অধিক পরিমাণে তাওবা-ইস্তিগফার করা; ৬. দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা; ৭. কবর জিয়ারত করা; ৮. নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সমস্ত মোমিন মুসলমান এবং বিশ্ববাসীর জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনায় দোয়া করা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close