মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ০৯ মে, ২০২১

বিশ্লেষণ

মহিমান্বিত রাত লাইলাতুল কদর

ফার্সি ‘শবেকদর’, আরবি ‘লাইলাতুল কদর’ অর্থ মহিমান্বিত রাত। এ রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। পবিত্র কোরআনে ‘কদর’ নামে স্বতন্ত্র একটি সুরা নাজিল হয়েছে। ৫ আয়াতের এ সুরায় লাইলাতুল কদরের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে ইসলামি শরিয়তে এর বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। আরবি মাসগুলোর মধ্যে রমজান যেমন শ্রেষ্ঠতম মাস, তেমনি রমজানের একটি রাত লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাত। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমি এই কোরআন কদরের রাতে নাজিল করেছি। কদরের রাত সম্পর্কে তুমি কী জানো? কদরের রাত হাজার মাস থেকে উত্তম মাস। এ রাতে জিবরাইলসহ সব ফেরেশতা অবতীর্ণ হন, প্রত্যেক কাজে তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সুরা কদর)

কোরআনের বর্ণনা দ্বারা পবিত্র এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে জানা যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান সহকারে এবং প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল কদরে নামাজ পড়বে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি : ১৯০১)। হাদিসে ইমান সহকারে কথাটির অর্থ হচ্ছে, এই রাতের মর্যাদা ও বিশেষ আমল শরিয়তসম্মত হওয়ার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আর প্রতিদানের আশায় কথাটির অর্থ হচ্ছে, নিয়তকে আল্লাহতায়ালার জন্য একনিষ্ঠ করা। সুরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয় আমি এটা কোরআন অবতীর্ণ করেছি একটি বরকতময় রাতে।’ আর এ রাত হলো শবেকদর। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘ফেরেশতারা এ রাতে রহমত, বরকত ও প্রশান্তি নিয়ে অবতরণ করেন।’ আবার কারো কারো মতে, ‘আল্লাহতায়ালা এ বছর যেসব বিষয় নির্ধারণ ও ফয়সালা করেছেন, ফেরেশতারা তা নিয়ে অবতরণ করেন।’

লাইলাতুল কদর অতি মূল্যবান রাত হওয়ায় মহান রাব্বুল আলামিনের সুনির্দিষ্ট তারিখ গোপন রেখেছেন। মুমিন বান্দা-বান্দিরা যেন এ রাতকে কষ্ট করে অন্বেষণ করে, যাতে তারা কেবল ওই নির্দিষ্ট তারিখই ইবাদত করে অন্য রাতে অলসভাবে না কাটায়। তাই রমজানের বেজোড় রাতগুলোকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করে পুরো রমজান বিশেষত শেষ দশকের বেজোড় রাতে বেশি বেশি ইবাদত ও কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। ফাতহুল বারি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ-সংক্রান্ত অভিমত ৪০টির ওপরে পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সঠিক মত হলো লাইলাতুল কদর রমজান মাসের শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাত। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি : ২০১৭)। রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলিলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন হাদিস থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ বিষয়টি আমরা এর আগেও উল্লেখ করেছি। তাই একজন মুসলিমের নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। কারণ এতে করে এমন বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, আসলে যে বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভবপর নয় এবং এতে করে ব্যক্তি নিজেকে প্রভূত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। হতে পারে লাইলাতুল কদর ২১তম রাতে অথবা ২৩তম রাতে অথবা ২৯তম রাতে। তাই কেউ যদি শুধু ২৭তম রাতে নামাজ আদায় করে এতে করে তিনি অফুরন্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং এই মোবারকময় রাতের ফজিলত হারাবেন। ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) কোরআনের সুরা কদরের গবেষণা করে করে ২৭ তারিখ লাইলাতুল কদর হওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তার গবেষণা সূত্র হচ্ছে, কোরআনে লাইলাতুল কদর শব্দটি তিনবার বলা হয়েছে। এ শব্দটিতে ৯টি অক্ষর আছে। সুতরাং ৩ গুণ ৯ = ২৭ রমজানে লাইলাতুল কদর হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। তাই সাতাশের রাতকেই সুনির্দিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর বলা উচিত নয়। খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায়, ‘এ রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। রমজানের শেষ দশকের ফজিলতই সবচেয়ে বেশি। প্রিয়নবী করিম (সা.) শেষ দশকে এতেকাফ করতেন।’ (মুসলিম : ১১৭১)

এ রাতে মহাগ্রন্থ কোরআন নাজিল হয়, মানবজাতির এই বিরাট নেয়ামতের কারণেই এ রাতের এত মর্যাদা ও ফজিলত। এই কোরআনকে ধারণ করলেই মানুষ সম্মানিত হবে, একটি দেশ ও জাতি মর্যাদাবান হবে; পুরো জাতির ভাগ্য বদলে যাবে। কাজেই এ রাতে বেশি বেশি কোরআন পড়তে হবে। কোরআনের শিক্ষাকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠার শপথগ্রহণ করতে হবে। বাছাই করা কিছু আয়াত এ রাতে মুখস্থও করা যেতে পারে। যাদের কোরআনের ওপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে তারা এ রাতে একটি দরসও প্রস্তুত করতে পারেন। কোরআনের এ গভীর অধ্যয়ন আমাদের সৌভগ্যের দ্বার খুলে দেবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের লাইলাতুল কদর সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য বের হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তির ঝগড়ার কারণে আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারি)। সুতরাং; দুই ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যকার ঝগড়াবিবাদ মিটিয়ে দেওয়া এ রাতের অন্যতম ইবাদত। তা ছাড়া হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! যদি আমি শবেকদর পেয়ে যাই, তবে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুল (সা.) বলেন, এ দোয়া পড়বে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নকা আফুয়্যুম তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাটা তুমি ভালোবাসো। তাই তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

উম্মতে মুহাম্মদ (সা.)-ই এই মহিমান্বিত রাত পেয়েছে। আর কোনো উম্মতের ভাগ্যে তা জোটেনি। মহান রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর মর্যাদা বৃদ্ধি এবং তার নৈকট্য অর্জনের সুযোগ হিসেবে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এ রাত দান করেছেন, যাতে তারা স্বল্প বয়সেও এ রাতে ইবাদত করে মহাসাফল্য লাভ করতে পারে। এই সুবর্ণ সুযোগ সদ্ব্যবহার করা আমাদের উচিত। সুতরাং একজন মুসলিমের উচিত পুরো রমজানে আনুগত্য ও ইবাদতের কাজে সর্বোচ্চ সাধনা চালানো। আর শেষ দশকে আরো বেশি তৎপর হওয়া। এটিই নবী (সা.)-এর আদর্শ। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন, ‘রমজানের শেষ দশ রাত্রি শুরু হলে রাসুল (সা.) কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তার পরিবারবর্গকে ইবাদাতের জন্য জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারি : ২০২৪)

আমাদের জন্য সমাগত কদর রজনিটি হোক অতীত কৃতকর্মের যাবতীয় অন্যায়ের ক্ষমাপ্রার্থনার কান্নাভেজা রজনি। এ রজনি হোক অন্যায়, অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্মকান্ড পরিত্যাগ করার দৃঢ় প্রত্যয়। এবারের লাইলাতুল কদর হোক শিরক-বিদআতসহ যাবতীয় কুসংস্কার সমূলে উৎখাতের এক বজ্র শপথ। এবারের শবেকদর হোক মহান মাওলার শাহি দরবারে অশ্রুর নজরানা পেশ করে মহান দরবার থেকে মহামুক্তি লাভের এক দীপ্ত প্রতিজ্ঞা। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close