সাহাদাৎ রানা

  ১৩ এপ্রিল, ২০২১

দৃষ্টিপাত

সবার সচেতনতায় সম্ভব কোভিড প্রতিরোধ

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যায় প্রতিদিনই রেকর্ড হচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগী জায়গা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ এমনিতেই আমাদের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর জন্য পর্যাপ্ত সিট নেই। তার ওপর দ্বিতীয় ঢেউয়ে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন যে হারে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে আগামীতে তা অব্যাহত থাকলে এমন সংকট কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা কঠিন। একদিকে হাসপাতালগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বেড নেই। আইসিইউও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। নেই পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। এসব খবরের মধ্যে শঙ্কার খবর হলো, করোনা রোগীদের চিকিৎসা সরঞ্জামেরও সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ার কারণে তৈরি হয়েছে সংকট। এ ছাড়া অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সংকটও দেখা দিচ্ছে। বিষয়টি সবার জন্য উদ্বেগের। এই সংকট দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করা সম্ভব না হলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে। তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। আইসিইউও, অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। গত বছর করোনা শুরু হওয়ার পর কয়েকটি জায়গায় হাসপাতালের সুবিধাসহ বেশ কিছু বেড তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোতে রোগী না পাওয়ার অজুহাতে গত বছরই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো দেশ থেকে করোনা বিদায় না নেওয়ার পরও কেন সেগুলো বন্ধ করা হলো। শুধু রোগীর সংখ্যা কমার কারণে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তবে এখন সেগুলো আবার চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এবং তা করতে হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই। কারণ যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে, তাতে করে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

এমন সংকটের খবর করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্রটাও নতুন করে সামনে উঠে আসছে। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেমন, এ বিষয়ে অনেকের কাছে হয়তো অজানাই থেকে যেত যদি করোনাভাইরাস না আসত এ দেশে। করোনাভাইরাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের চলমান দুরবস্থার কথা। এই খাতটি আসলে কতটা দুর্বল ও নাজুক, তা করোনা প্রমাণ করল আবারও নতুন করে। সহজ কথায় করোনার প্রভাবে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে গেলে একেবারে ভেঙে পড়েছে। মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এ ছাড়া রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। শুধু তাই নয়, পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে; যা আছে তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অবশ্য শুধু করোনার কারণে নয়, কয়েক বছর ধরে সামান্য ডেঙ্গু রোগ আমাদের যে পরিমাণ ভুগিয়েছে, তা এখনো কেউ ভুলে যায়নি। এ কারণে করোনা নিয়ে বাড়তি ভয় সবার মধ্যে। সবচেয়ে বেশি ভয় আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে। করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই ভয় আরো বাড়ছে।

বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো নানা কারণে স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। কারণ যখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো তাদের চিকিৎসাসেবায় ব্যয় বাড়াচ্ছে, বাড়াচ্ছে মান। সেখানে আমরা পিছিয়ে আছি অনেকটা। এখানে আরো একটি তথ্য সবার জন্যই অস্বস্তির। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন মানুষের জন্য রয়েছে একজন ডাক্তার; যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এখানে আরো শঙ্কার খবর হলো, আমাদের সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের বেশির ভাগই নিজেদের বহন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র থেকে শুরু করে ওষুধের খরচ পর্যন্ত। ফলে অন্যান্য খাতে ব্যয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচ জোগাতে সাধারণ মানুষকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। করোনাকালে যা আরো নতুন করে সবাইকে জানান দিয়েছে। এখানে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে সেটা হলো আস্থার অভাব। দেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি আস্থাশীল নয় সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য খাতে সুরক্ষার বিষয়টির সঙ্গে চিকিৎসকদের ভূমিকা বিশেষভাবে জড়িত। কিন্তু তারা কতটা রোগীবান্ধব, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়।

আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য আশার খবর। তবে এমন আশার খবরের বিপরীতে কিছু অস্বস্তির খবরও রয়েছে আমাদের জন্য। করোনাভাইরাসের শুরুর সময়ে সাধারণ রোগীরা তাদের স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। এ কারণে সাধারণ রোগীরা এখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অনেকের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় সাধারণ রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। করোনা ছাড়াও সারা দেশে লাখ লাখ সাধারণ রোগী রয়েছেন। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ও হৃদরোগসহ অন্যান্য অসুখে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব রোগী এখন হাসপাতালেও যেতে পারছেন না। এখানে সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনরা। সাধারণ রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে করোনা সন্দেহে সেখানে ভর্তি করানো হচ্ছে না। অথচ কেউ ভেবে দেখেন না, করোনা ছাড়াও দেশে অনেক সাধারণ রোগী রয়েছেন এবং অন্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তাই তাদেরও চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বে এখন আলোচনার প্রধান বিষয় করোনাভাইরাস। এর বিরূপ প্রভাবে প্রায় থমকে গেছে বিশ্ব। থেমে গেছে প্রায় ৬০০ কোটি মানুষের জীবনযাত্রাও। এমন পরিস্থিতির মূল কারণ প্রতিদিনই বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কঠিন এ অবস্থা থেকে বিশ্ববাসী কবে নাগাদ মুক্তি পাবে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। আপাতত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মুখে মাস্ক পরে যতটা সম্ভব ঘরে থাকাটা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। মাস্ক পরাটাই একমাত্র পথ। তাই সেই পথেই হাঁটছে পুরো বিশ্ব। আমাদের জন্য করোনাভাইরাসের বিষয়ে সবচেয়ে আশার খবর হলো, করোনা একটি ছোঁয়াচে রোগ হলেও অধিকাংশ মানুষ এ রোগে সুস্থ হয়ে যান। এরই মধ্যে সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে সারা দেশে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত অবশ্যই ইতিবাচক। তবে শুধু লকডাউন দিলেই হবে না। কঠোরভাবে তা বাস্তবায়নও করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাসার বাইরে বের হলে তাকে জরিমানার আওতায় আনতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ ক্ষেত্রে আরো বেশি কঠোর হতে হবে। বিশেষ করে সারা দেশের স্থানীয় প্রশাসনকে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ যে হারে করোনাভাইরাস বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা সবার জন্যই ভয়ের। এ ক্ষেত্রে করোনা প্রতিরোধে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নেই। সতর্ক ও সচেতনতার মধ্য দিয়ে মূলত করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। সবাইকে মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি জরুরি। বিশেষ করে নাগরিকদের সচেতনতা এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে সচেতন হতে হবে যার যার জায়গা থেকে। সবাইকে থাকতে হবে ঘরে। সবার সচেতনতায় সম্ভব করোনা প্রতিরোধ করা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close