মো. রেজাউর রহমান

  ০৯ মার্চ, ২০২১

মুক্তমত

এ সময়ের কথা

স্বাধীনতা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। যে অর্জনের মূলে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের ত্যাগ। কালের বিচারে সেই ত্যাগ কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। বিশেষ করে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরে দেশে যে পটপরিবর্তন ঘটে, এতে কারা লাভবান ছিল। কারা জাতির ইতিহাসে কালিমালেপন করেছিল? তা খতিয়ে দেখতে হবে; যা কোনোভবেই ভুলে গেলে চলবে না। সে প্রেক্ষাপটে বলতে চাই, ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে আমার বড় ভাই মরহুম খলিলুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে দেশে আসেন, দেশে এসে তিনি আর পাকিস্তানে ফিরে যাননি। এর আগে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পর তিনি যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পরবর্তীকালে স্থানীয় এমপি হাবিব চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শুনেছি বহু অনেক কলেজছাত্রদের তিনি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের পৈশাচিক ঘটনার পর কোনো এক দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় ঘাতক রাজাকাররা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে। ঘাতকরা বাবাকে ধরে নিয়ে মসজিদের পাশে গুলি করার হুমকি দেয় ও বড় ভাইকে আত্মসমর্পণ করার জন্য বলে। বাবা কিছুটা উর্দু জানত, তাই তিনি ওদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, বড় ভাই তার কথা শুনে না এবং কোথায় আছে তাও জানে না, তবে দেখা পেলেই ওদের খবর দিয়ে ধরিয়ে দেবে।

পাকিস্তানিরা কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বাবাকে এক সপ্তাহ সময় দিয়ে চলে যায়। সেদিন রাতেই বাবা আমাদের ৬ ভাই-বোন, মা ও ভাবিসহ সবাইকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বহু দূরে চরাঞ্চলে ফুফুর বাড়িতে আশ্রয় নেন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আমরা এখানে-ওখানে পালিয়ে থেকেছি। কখনো ফুফুর বাড়ি, কখনো মামার বাড়ি, কখনো ধানখেতে, কখনো নৌকায় রাত কাটিয়েছি। ভাবি ও আমার বড় বোনদের মুখে মা সারাক্ষণ কালি মেখে রাখতেন। কত কষ্ট, কত ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করেছি, যা ব্যাখ্যা করার বিষয় নয়, অনুভবের বিষয়। পটুয়াখালী বিজয়ের পর ডিসেম্বরের কোনো এক দিন মুক্তিবাহিনীর এক বিশাল দল নিয়ে বড় ভাই খলিলুর রহমান বাড়িতে আসেন। এ সময় বাবাও আমাদের নিয়ে বাড়ি ফিরেন। সে কী মহা-আনন্দ, সেদিন বাবা খাসি জবাই করে সবাইকে আমাদের বাড়িতে খাওয়ার দাওয়াত করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, সেদিন আমি সব মুক্তিযোদ্ধা ভাইকে পানি পান করিয়েছি। সে কথা মনে হলে আজও আমি নিজেকে জনম জনমের ধন্য মনে করি।

স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দিয়ে বড় ভাই ঢাকা চলে আসেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে যথানিয়মে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা। পরবর্তী সরকার দালাল আইন প্রত্যাহার করে। একাত্তরের পরাজিত ঘাতকদের এ দেশে পুনর্বাসনসহ রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। ধীরে ধীরে তৃণমূল থেকে সেসব ঘাতক-দালাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়। পর্যায়ক্রমে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করতে থাকে। যেহেতু আমাদের পাশের গ্রামেই ছিল এক পাকিস্তানি দালালের বাড়ি তাই আমাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রাও বেড়ে যায়। নানা অজুহাতে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে আমাদের পরিবারকে নানাভাবে ক্ষতিসাধন করতে থাকে। যে কারণে সেসময় বাবা আমাদের নিয়ে ঢাকা চলে আসেন। এরপর শুরু হয় নতুন এক যুগের। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধনের কাজ, আর এ কাজ পায় আলবদর, রাজাকার ও দালালদের সহযোগীরা। তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত করেনি। তারা তাদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম তালিকাভুক্ত করেছে।

আমার বড় ভাই সিপাহি মো. খলিলুর রহমান (সিপাহি নং-১৩৩৭৪২৩), ৯নং সেক্টরের অধীন পটুয়াখালী আমতলী, গলাচিপা অঞ্চলে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমামের অধীন যুদ্ধ করেছেন। পটুয়াখালীর মুক্তিবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট মঈনুল ইসলাম সাহেব ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি তারিখে তাকে প্রশংসাপত্র প্রদান করেছেন এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র জমাদানের সার্টিফিকেটও তার রয়েছে। ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমামের স্বাক্ষরিত প্রশংসাপত্র এবং মুজিবনগর সরকারের প্রশংসাপত্রও রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অনেক জায়গায় ঘুরেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের নাম গেজেটভুক্ত করতে পারনেনি। পরিশেষে নানা রোগে শোকে ভুগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। দুঃখজনক হলো, আমরা যতই স্বাধীনতার চেতনার কথা বলি, কিন্তু সেই চেতনাকে লালন করি না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ দীর্ঘ সময় ধরে পড়েছিল রক্তাক্ত অবস্থায়। অথচ এ দেশে রাজাকারের গাড়িতে উড়েছে স্বাধীনতার পতাকা।

বহু দিন আগে শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নঈম নিজামের একটা লেখা পড়েছিলাম। লেখাটি ছিল নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের অন্যতম আসামি নুর হোসেনকে নিয়ে। যে কি না ট্রাকের হেলপার থেকে শতকোটি টাকার মালিক বনেছে। নইম নিজাম ভাই লিখেছিলেন, একটি আগ্নেয় অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগে আবেদন করেছিলেন, কিন্তু তাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। অথচ অশিক্ষিত খুনি নুর হোসেনকে একাদিক আগ্নেয় অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এ হলো বাস্তবতা।

আমার বড় ভাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। স্বাধীনতার পর যোগ দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্রের কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোথাও থেকে কোনো সাহায্য কিংবা সহযোগিতা পাননি। আমার সেজো ভাই মো. আতিকুর রহমান পুলিশ সিপাহি থাকাবস্থায় রাঙামাটিতে গুলিবদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অথচ আমরা কোনোভাবেই সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাব। অথবা গেজেটভুক্ত হবে, এ আমাদের কাম্য নয়। আমরা চাই, সঠিক তদন্তসাপেক্ষে আমার ভাইকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হোক। পরিশেষে এই আশায় বুক বেঁধে আছি ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়’ যদি তাই হয়, বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা মানবতার মাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিকই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করবেন এবং তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করবেন। যাদের অসীম ত্যাগে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে।

লেখক : সমাজকর্মী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close