জান্নাতুন নিসা

  ০৯ মার্চ, ২০২১

দৃষ্টিপাত

নারীরা দিয়েছেন সঠিক পথের দিশা

নারীর প্রথম অক্ষরটিই ‘না’। তাই হয়তো একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে এসেও নারীকে শুনতে হয় ‘না’। অথচ সভ্যতার প্রতিটি পর্যায়ে রয়েছে নারীর অবদান। কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে নারীর মেধা, শ্রম, অভিজ্ঞতা, দায়িত্বশীলতা ও মমতা জড়িয়ে আছে মানবজাতির বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে। আর আজ সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা যখন এসে মিশেছে এই রোবটিকস যুগে; যেখানে সমাজের বিবর্তন, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সবক্ষেত্রে নারীর সার্বজনীন উপস্থিতিতে প্রমাণ করে ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত নারীর এ বীরত্বগাথায় উল্লেখ হয়­ নারীর ভূমিকা সমাজ-সভ্যতার অগ্রযাত্রার ইতিহাসে সমান্তরাল।

প্রাচীনকালেও সংসার পরিচালনা এবং সন্তান প্রতিপালন ছাড়াও নারীর অংশগ্রহণ ছিল কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য এমনকি সমরেও। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে চাষাবাদের অগ্রগতি, নিত্যনতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার, সমাজ জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনলেও ধীরে ধীরে নারীর আসনটিকে সমাজে পুরুষের চেয়ে অধস্তন করে দেয়। বহির্মুখী প্রবণতা ও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে পুরুষ প্রযুক্তিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এ সময়ে নারীরা পারিবারিক পরিচর্চায় মনোনিবেশ করেন। সময়ের বিবর্তনের পাশাপাশি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় পুরুষতান্ত্রিক পরিবার, ব্যক্তিমালিকানা, শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। এগুলোর সঙ্গে পুরুষের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে যুক্ত হয় রাষ্ট্র। সেই যে নারীরা বৈষম্যের শিকার হলেন, যুগের পর যুগ তা-ই চলে আসছে। একুশ শতকে তো নারী একই সঙ্গে পরিচালনা করছেনÑ পরিবার, কর্মক্ষেত্র, সমাজ এবং রাষ্ট্র। তবে খুব অল্পসংখ্যক নারী পেয়েছেন তাদের কাজের স্বীকৃতি ও সম্মান। আর সেজন্যই সমাজে নারীর ওপর চলছে এত নির্যাতন।

সংস্কৃত নৃ শব্দটি থেকে নারী শব্দটির উৎপত্তি (নৃ+ঈ=নারী)। মানবচক্রের যেই মাধ্যমে আমাদের এই পৃথিবীতে আগমন, তার গুরুত্বপূর্ণ অপার মাধ্যম নারী। এই নারী কখনো মা, কখনো বোন, কখনো স্ত্রী, কখনো কন্যা। হাজারও সম্পর্কের মাঝে নারীর সঙ্গে সবার সম্পর্ক অন্যরকম মধুর। ঘরে-বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই নারী রেখে চলেছেন অসামান্য অবদান। নারীর এই ভূমিকা শুধু এ সময়ের নয়, বরং যখন নারী ছিল অন্তঃপুরবাসিনী, তখন পরিবার আর সমাজ নির্মাণে তারা রেখেছেন অবদান। সুষ্ঠুভাবে সংসার পরিচালনা, সন্তান প্রতিপালন করেছেন তারা। সন্তানদের শিখিয়েছেন মূল্যবোধ, দিয়েছেন সঠিক পথের দিশা। নিজেকে অন্যের সুখে হাসতে হাসতে বিলিয়ে দিতে পিছপা হন না এই নারী। তাই হয়তো একচেটিয়াভাবেই ভালোবেসে সমস্যা ও সমাধানের হালটি কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে তাকে। আধুনিক নারীকে বলা যায় স্বয়ংসম্পূর্ণা। ঘরে-বাইরে অর্থাৎ একই সঙ্গে সংসার ও কর্মক্ষেত্রে তারা রেখে চলেছেন তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সব ক্ষেত্রেই রয়েছে তাদের অসামান্য অবদান।

নারীর অধিকার নিয়ে প্রথম শোরগোল হয় ১৭৯২ সাল বা তারও কিছু আগে, যখন মেরী ওলস্টোনকাফ্ট তার ‘নারীর অধিকারকেন্দ্রিক যৌক্তিকতা’ আর্টিকেলটি প্রকাশ করেন। অন্যদিকে নারীবাদী চিন্তাধারার সুনিপুণ ব্যাখ্যা করেন ইলেন সোল্টার। এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণা, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, শরীরতত্ত্বীয় গঠন, বিবর্তনবাদ, চিন্তনজগৎ, মনোজগৎ, মনোবিশ্লেষণ, লিঙ্গভেদ, জ্ঞান ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া, সর্বশেষ স্ত্রীবাদী ভাবনা। এ ছাড়া রয়েছে সমন্বয়বাদী এবং মানবতাবাদী চিন্তাধারা। ১৮৫৭ সালে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে মালিকপক্ষের দমনপীড়ন। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন।

এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭ দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসেন বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। প্রথমদিকে মূলত বামপন্থিরাই দিবসটি পালন করতেন। ১৯১৪ সালে সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে নারী দিবস পালন করা হয়। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর থেকে নারী দিবস সাড়ম্বরে পালন করা হয়। ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকোয় জাতিসংঘ স্বাক্ষর করে ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটি’ চুক্তিতে নারী অধিকারের যৌক্তিক দাবিগুলো বিবেচনায় রাখে। বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে।

স্বাধীনতা পূর্বকালে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে নারী দিবস পালন করা হয় ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নারী দিবস পালন করা হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ সেই সঙ্গে ১৯৭৫ সালকে ‘নারীবর্ষ’ ঘোষণা করা হয়। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এরপর থেকে সারা পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটিÑ নারীর সম-অধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের জন্য উত্থাপিত বিল অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ’ প্রণয়ন করে।

আন্তর্জাতিক দিবসগুলোর তাৎপর্যের ওপর এগুলোর পোস্টার বা প্রতীকের রং বেছে নেওয়া হয়। যেমন বিশ্বশান্তি দিবস সবুজাভ নীল, বিশ্ব শ্রম দিবস বা মে দিবস লাল, বিশ্ব পরিবেশ দিবস সবুজ, সিডও বাস্তবায়ন দিবস কমলা ইত্যাদি। সেই হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস মূলত বেগুনি আর সাদা। কারণ এ রং ভেনাসের; যা কি না নারীরও প্রতীক। বেগুনি নির্দেশ করে সুবিচার ও মর্যাদা; যা দৃঢ়ভাবে নারীর সমতায়নে সংশ্লিষ্ট। বেগুনি রংটা নারীবাদীদের প্রতিবাদের এক ধরনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে। ১৯৮৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ লেখক এবং নারীবাদী অ্যালিস ওয়াকারের প্রশংসিত উপন্যাস ‘দ্য কালার পারপল’ বইটি এর অনুপ্রেরণা। এ বইতে তিনি তুলে ধরেছেন নারীদের অধিকারের কথা। মনে করা হয়, সেখান থেকেই নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গেছে এই রংটা। সংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ১৯৮৪ সালের ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘ; ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে বিশ্বের ২৯ দেশে সরকারি ছুটিসহ প্রায় ৬০ দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। ২০১০ সালে বিশ্বজুড়ে নারী দিবস পালন করা হয়। এরপর থেকে সারা পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে দিবসটি নারীর সম-অধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার ইচ্ছা নিয়ে।

শিল্প বিপ্লবের পর কোন প্রেক্ষাপটে নারীদের জন্য একটি আলাদা দিবসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে না টেনেও যদি সেদিনের বাস্তবতাকে এখনকার বাস্তবতায় বসানো যায়; তাহলে হয়তো একটা তুলনামূলক চিত্র আমরা দাঁড় করাতে পারব। ১৯ শতকের যে দিনটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়েছিল, সেদিন যেসব দাবি নিয়ে মিছিল বা র‌্যালিটি হয়েছিল; সেখানে খুব শক্ত কোনো দাবি ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেখানে ছিল রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ যেসব ক্ষেত্রে নারীদের বিচরণ আছে, সেসব জায়গায় নারীর অবস্থানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নারীর অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে একে অপরের সাহায্যের হাতটিকে শক্ত করে ধরে রাখার দাবি। কিন্তু আদৌ কি দাবি পূরণের পথ সুগম হয়েছে? তবে এই পথকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে ১৯৯৬ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতি বছরই নারী দিবসের একটি করে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে! ২০১৮ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ রিপোর্ট অনুসারে দেখা যায়, সারা বিশ্বে জেন্ডার গ্যাপ দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। অর্থাৎ নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো প্রায় ২০০ বছর পিছিয়ে আছে। যদিও রিপোর্ট বলছে, নারীরা বিচ্ছিন্নভাবে নিজেরা অনেক বেশি এগিয়ে আসছেন, চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন, দিচ্ছেন। নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন ও সচলভাবে এগিয়ে চলছেন।

৮ মার্চ মনে করে দেয়, নারী কেবল প্রেয়সী বা প্রেমিকা হওয়ার জন্য জন্মাননি, তিনিও সমানতালে তার পুরুষ সহকর্মীর পাশাপাশি কাজ করার মতো যোগ্যতা রাখেন। তারও আছে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, নিজের মতো করে উড়তে চাওয়ার অধিকার, যখন যেমন ইচ্ছা চলার। নিজের মতো করে পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, আছে সঙ্গী বেছে নেওয়ার যোগ্যতা। জাতিসংঘের কথায়, এ দিনটিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারীদের সব ধরনের কাজে স্বীকৃতি দেওয়ার দিন। ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নারীদের কাজকে স্বীকৃতি জানানো হয় এদিন। অতীতের সব ধরনের লড়াই, সাফল্যকে কুর্নিশ জানানোর পালা এদিন। একই সঙ্গে ভবিষ্যৎকে আরো দৃঢ় করার শপথও নেওয়ার পালা। সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে নারীর অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যতœবান হতে হবে, নয়তো আমাদের এত আয়োজনের সবটাই ব্যর্থ মনোরথ হয়ে পড়বে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারীনেত্রী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close