মীর আবদুল আলীম

  ০২ মার্চ, ২০২১

মুক্তমত

ভেজালের বিরুদ্ধে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

অনিরাপদ খাদ্যপণ্য নিয়ে দেশে দীর্ঘদিন ধরে কথা হচ্ছে; জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এ প্রেক্ষাপটে মনে পড়ছে ডিএল রায়ের (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়) বিখ্যাত গানের পঙ্ক্তিÑ ‘কত কিছু খাই ভস্ম আর ছাই’। এই পঙ্ক্তির সঙ্গে আমাদের বাস্তবতার অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার এই অপপ্রক্রিয়া যে টোটকা দাওয়াইয়ে বন্ধ হবে না, বিদ্যমান বাস্তবতা এ সাক্ষ্যই দেয়। দরকার কঠোর প্রতিকার ও অব্যাহতভাবে ভেজালবিরোধী অভিযান।

ভেজাল নেই কোথায়! অসাধুরা ভেজাল দিচ্ছে, আমরা ভেজাল খাচ্ছি; ভেজাল বলছি, ভেজাল করছি। ভেজালের যেন এক মহারাজত্ব। অনেকেই বলেন, এ দেশে শুধু খাদ্যে নয়; বিষেও নাকি ভেজাল আছে। কথা মিথ্যে নয়। আমরা প্রতিক্ষণে জেনেশুনে বিষপান করছি। আর এ বিষয়ই আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। হাসপাতালে গেলে বোঝা যায় কত ধরনের রোগই না মানবদেহে বাসা বেঁধেছে! বিএসটিআই অধ্যাদেশ-১৯৮৫ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়া, পরীক্ষা পদ্ধতির জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে। পালনীয় বিধানাবলি ভঙ্গের জন্য কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের আইনও রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। অর্থাৎ ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব আইনে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, শাস্তির বিধানসংবলিত আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ভেজালকারীদের এত দৌরাত্ম্য সম্ভব হচ্ছে কীভাবে? বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে ত্রুটি এমন অভিযোগও কম নয়। আমাদের স্মরণে আছে, নিকট অতীতে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিল।

মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছুই খাদ্যে মিশ্রণ করা যাবে না এটাই বিধান কিংবা আইন। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এ আইন মানছেন না। এরা মানবতা, সভ্যতার শত্রু। এদের প্রতি কোনো অনুকম্পা দেখানো যাবে না। যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে কঠোর অবস্থান নিয়ে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের জনবল ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে যারা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের কোনো ছাড় নয় এই হলো শুভবোধসম্পন্ন সবার দাবি। খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে এভাবে ভেজালের সংমিশ্রণ চলতে থাকলে অসুস্থ মানুষের হার বাড়বে; প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে। সামগ্রিক স্বার্থে এ ব্যাপারে সরকারের আরো কঠোর হতে হবে। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও আমদানি করা খাদ্যের মান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা দরকার।

প্রশ্ন হলো ভেজালের বিরুদ্ধে আমরা কতটা সোচ্চার? জীবন বাঁচানোর তাগিদেই ভেজালবিরোধী আন্দোলনে যূথবদ্ধভাবে নামা দরকার। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আমজনতা, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা প্রদর্শনের কোনো অবকাশ নেই। এ অবস্থায় সর্বতোভাবে তৎপর হতে হবে বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। শুধু যে খাদ্যপণ্যেই ভেজাল দেওয়া হচ্ছে, তা নয়। সবকিছুতেই ভেজালের ছড়াছড়ি। সর্বোপরি ভেজাল প্রতিরোধে জনসচেতনতা একান্ত দরকার। গ্রামগঞ্জ, শহর-নগরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একযোগে আওয়াজ তুলতে হবে ভেজালকারীদের নিস্তার নেই, আইনানুগ বিচার চাই। মানুষ তো বাঁচার জন্য খায়; মরার জন্য নয়। খাদ্য যদি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা বেদনাদায়ক, দুঃখজনক। বিষয়টি নিশ্চয় সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা আরো গুরুত্বসহকারে ভাববেন এ আমাদের প্রত্যাশা। ভেজালের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে এ পর্যন্ত কথাবার্তা কম হয়নি, কিন্তু কাজের কাজ কতটা হয়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এভাবে চলতে পারে না। নিরাপদ খাদ্যপণ্য চাই, ভেজালকারীদের মূলোৎপাটন চাই।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close