আরিফুল ইসলাম 

  ০১ মার্চ, ২০২১

পর্যালোচনা

রুখতে হবে আত্মহত্যার প্রবণতা

আজকাল পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যায় আত্মহত্যার খবর। এসব আত্মহননকারীর বেশির ভাগই তরুণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন বেছে নিতে হবে আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ? কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় এর পরিধি বিস্তৃত। তবে বর্তমানে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে হতাশা ও মানসিক চাপ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই হতাশার পেছনে আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। এ ছাড়া আরো অনেক কারণ যেমন- জীবিকার জন্য চাকরি না পাওয়া, সম্পর্কে ভাঙন, অপমান সহ্য করতে না পারা, পরীক্ষায় ফেল করা, সাইবার বুলিংয়ের শিকার, তর্ক-বিবাদ, পরিবারে আর্থিক অনটনসহ ক্ষেত্রবিশেষে পারিপার্শ্বিক নানান কারণে তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যা করছে। এক জরিপ অনুযায়ী সারা বিশ্বে আত্মহত্যায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪তম। পৃথিবীর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, তার মধ্যে ২.০৬ শতাংশ বাংলাদেশি।

বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখে ১২৮.০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি বছর এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ বা প্রায় ৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এরাই আত্মহত্যার চরম ঝুঁকিতে অবস্থান করছে। মহামারি করোনাকালে আত্মহননের রূপ ভয়ংকরভাবে দেখা গেছে। গেল বছর ২০২০ সালে আত্মহত্যার মিছিলে পা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ১১ জনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থী।

নয়া বছর ২০২১ সালেও থেমে নেই আত্মহত্যা। আত্মহত্যা রোধে সামাজিক আন্দোলন ও দেখা যায় না। আমাদের দেশের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও কখনো এর কারণ জানার চেষ্টা করেন না। ফলে আত্মহত্যার মতো ঘটনা যেন থামছেই না। বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা জিপিএ নির্ভর হয়ে পড়েছে। সমাজের সিংহভাগ অভিভাবকই সন্তানের মাথায় একটি বিষয় ঢুকিয়ে দেয় তা হলো জিপিএ-৫ পেতেই হবে, তা না হলে সমাজে তাদের মানসম্মান থাকবে না। আমাদের দেশে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ও সচ্ছল বাবা-মায়ের এমন মানসিকতা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগোচর হয়। অভিভাবকের এমন প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব শিক্ষার্থীদের এক ধরনের মানসিক চাপ ও ভীতি সৃষ্টি করে। ফলে তারা বিষণœœ ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দেখা যায়, প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পরে যেসব শিক্ষার্থী কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন করতে পারে না তারা আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নেয়। মূলত পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে না পারা ও সহপাঠীদের কাছে মুখ দেখানোর গ্লানি ও চাপ সহ্য করতে না পেরে তারা এই কাজটি করে। এ ধরনের আত্মহত্যার কারণ হিসবে শিক্ষার্থীদের পরিবার দায় এড়াতে পারে না। আমাদের দেশে অনেক পরিবারের বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। ফলে দুর্বলতা ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা আত্মহত্যা করে থাকে। একজন শিক্ষার্থীর বেড়ে ওঠার পেছনে পরিবারের সহযোগিতামূলক আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ পরিবারে সন্তানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণের অভাব দেখা যায়, যা সন্তানের জন্য সুফল বয়ে আনে না।

সবারই নিশ্চয় মনে আছে, ২০১৩ সালের ১৪ আগস্টের কথা? বলছি ঐশির কথা, যে কি না পিতা-মাতার অতিরিক্ত শাসন এবং বয়ঃসন্ধিকালে সঠিক পরিচর্যার অভাবে মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে একপর্যায়ে মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল ইত্যাদি নেশায় মেতে ওঠে এবং সে একাই তার মা-বাবাকে খুন করে। তাই পরিবারের উচিত সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা। এ ছাড়া আমাদের দেশে অনেক পরিবারে বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ সন্তানের আত্মহননের কারণ। অন্যদিকে বর্তমানে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে আত্মত্যার ঘটনা বেশি শোনা যায়। দেশের ৪৯ শতাংশ কিশোর-কিশারী এই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। ছোটখাটো ঝামেলা, সম্পর্কে টানাপড়েন ইত্যাদি হলেই প্রেমিকার আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে তরুণরা, যার ফলে নিজের আপত্তিকর ছবি দেখে আত্মহত্যা করছে অনেক তরুণী। দেশে বেড়েছে ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা, এতে অনেক ধর্ষণের শিকার তরুণী সমাজে মানসম্মানের কথা চিন্তা করে আত্মহনন করছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে আত্মহত্যা এক ধরনের সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মহত্যা ‘মহাপাপ’ জেনেও তারা এই কঠিন পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, এই বৃত্ত থেকে তরুণ প্রজন্মকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজ আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দায় এড়াতে পারে না। আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। একজন শিক্ষার্থী কেন আত্মহত্যা করেছে, সে বিষয়টি জানতে হবে এবং নিয়মিত শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা জানার চেষ্টা করতে হবে এবং তা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যা নিয়ে নেই কোনো সচেতনতা। শিক্ষার কোনো অংশেই এটির নেতিবাচক ধারণাও দেওয়া হয় না। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য ও গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক কাজের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে, তাহলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমতে থাকবে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের ব্যবহার নিয়ে আরো সচেতন করতে হবে, যাতে করে তারা সাইবার বুলিংয়ের শিকার না হয়। আত্মহননের পেছনে আমাদের পরিবারগুলোরও দায় রয়েছে। তাই প্রতিটি পরিবারের উচিত শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত চাপ না দেওয়া, ভালো ফলাফলের চেয়ে ভালো মানুষ হওয়ার বিষয়ে সন্তানদের আরো উৎসাহিত করতে হবে। এ ছাড়া তাদের বিভিন্ন শখের বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহপাঠীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আত্মহত্যা কোনো প্রতিবাদের ভাষা নয়, এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আমাদের জীবনকে উপভোগ করতে শিখতে হবে। আত্মহত্যাকে প্রতিরোধে সমাজের সবাই মিলে যেমন সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, তেমনি তরুণদের অনুকূলে গড়তে হবে নান্দনিক পরিবেশ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close