নাসরিন জাহান

  ০১ মার্চ, ২০২১

মুক্তচিন্তা

আর নয় ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার

বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল যুগ। প্রযুক্তির কল্যাণ কাজে লাগিয়ে সমগ্র বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় এসেছে। পরিণত হয়েছে ছোট একটি গ্রাম বা ভিলেজে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে দেশ, দেশ থেকে বিদেশ। ইন্টারনেটের কল্যাণে আজ ভৌগোলিক সীমারেখা যেন মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সাধারণত ডিজিটাল প্রযুক্তি বলতে বোঝায় ডিজিটাল ডিভাইস বা ডিজিটাল সিস্টেমের আধুনিকায়ন তথা কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবেশনের উন্নত এবং দ্রুততম মাইক্রোইলেকট্রনিক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া। যুগ যুগ ধরে বিবর্তনের ফলে একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রকৃতিতে যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, তার অন্যতম কারণ হলো কম্পিউটার, মোবাইল, ফ্যাক্স, ইমেইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটারসহ নানাবিধ ডিজিটাল ডিভাইসের আবিষ্কার। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া প্রকৃতি যেন দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। তাই প্রকৃতির সঙ্গে তালমিলিয়ে বাংলাদেশও তাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা।

বর্তমানে আমাদের দেশ তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকায়নে মানানসই অবস্থানে বিদ্যমান। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে আমাদের দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। ডিজিটাল প্রযুক্তির আবিষ্কার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যেমন গতি এনেছে; তেমনি হাজারো বিড়ম্বনাও সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি জিনিসের যেমন ভালো দিক থাকে; তেমনি তার একটি খারাপ দিকও থাকে। আলফ্রেড বার্নাড নোবেল যখন শক্তির আধার হিসেবে ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন, তখন তিনি এর খারাপ দিকটি ব্যবহারের কথা চিন্তাও করেননি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আজ শক্তির আধার এই ডিনামাইট ব্যবহার হচ্ছে প্রতিশোধপরায়ণ কাজে ও ধ্বংসাত্মক তান্ডবলীলায়। একইভাবে বিশ্বকে আধুনিক বিশ্বে রূপায়িত করতে যেসব ডিজিটাল ডিভাইস আবিষ্কার করা হয়েছে তারও এখন ঘটছে অপপ্রয়োগ।

ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব আজ যে সুবিধাগুলো ভোগ করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো অনলাইনে ইন্টারনেটের সহায়তায় বিভিন্ন পত্রিকা পড়া, প্রয়োজনীয় পণ্যের অর্ডার, বিল পরিশোধ, ই-বুকিং, চাকরির আবেদন ও প্রবেশপত্র সংগ্রহ, অনলাইন টিকিটিং সিস্টেমের মাধ্যমে ঘরে বসেই ট্রেন অথবা প্লেনের টিকিট বুকিং দেওয়া ইত্যাদি। একই সঙ্গে অগ্রগতি হয়েছে কম্পিউটার ব্যবহার করে অতিদ্রুত বড় বড় গাণিতিক সমস্যার সমাধানে ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা লেনদেনসহ মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যোগাযোগ রক্ষণে। আজ ডিজিটাল প্রযুক্তির বদৌলতে সহজে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন সহজ হয়েছে। তাছাড়া চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে এসেছে এক অভাবনীয় সাফল্য। অনলাইনে এক দেশ থেকে অন্য দেশের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যাচ্ছে অতিদ্রুত। সম্প্রতি একটি বিদেশি সংস্থা ৯০ দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে যে, ৭৭ দেশ ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অধিকতর সেবা দিতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া উল্লেখ্য যে, বর্তমান করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সংসদীয় কার্যক্রম থেকে শুরু করে দেশের সর্বপ্রকার ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কর্মকান্ডই যেন একপ্রকার চলছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে ই-পার্লামেন্ট বা ইলেকট্রনিক সুবিধা সংবলিত সংসদ ‘রূপকল্প ২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে সংসদে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হচ্ছে। ফলে সংসদ হয়ে উঠেছে মতবিনিময় সভা ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। যেখানে মুখ্য গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে নির্বিঘেœ।

ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় এই সাফল্যের পরেও কোথাও যেন তার ব্যর্থতা রয়েই গেছে। অসাধ্য সাধনকারী এ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ঘটছে এখন অপপ্রয়োগ। যার ফলে শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সি মানুষ এর কিছু খারাপ দিকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে করে ব্যক্তিজীবন হয়ে পড়ছে সংকটাপন্ন এবং সামাজিক জীবন হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ। এ ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। সাইবার ক্রাইম বলতে বোঝায় তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে কোনো অপরাধ সংঘটিত করা। সাইবার অপরাধীরা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ও তাদের ছবি, ব্যক্তিগত ঠিকানা, ফোন নাম্বার ব্যবহার করে নানা ধরনের বে-আইনি কার্য সংঘটন করে থাকে। এতে করে সমাজে ও ব্যক্তির সম্মানের হানি ঘটে। হ্যাকিং বলতে বোঝায় কারো বৈধ অনুমতি ছাড়া কম্পিউটার বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তথা ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তিতে অনুপ্রবেশ করা এবং তার অপব্যবহার ইত্যাদি। তথ্যপ্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ৫৭ (১) ধারাতে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যেটা মিথ্যা ও অশ্লীল, যার দ্বারা কারো মানহানি ঘটে বা ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে; তাহলে উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি অনধিক ১৪ বছর ও অন্যূন ৭ বছর কারাদন্ড এবং অনধিক ১ লাখ টাকা জরিমানা ভোগ করবেন। বর্তমানে অতিমাত্রায় প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও মনোবৈকল্য সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সংঘটিত হচ্ছে ধর্ষণ ও হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ।

সম্প্রতি মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, শহরের স্কুলগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। যার কারণে তারা তাদের পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে পড়ছে অতিঅল্প বয়সেই। আর এ পর্নোগ্রাফি তৈরি করা হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে। এমনকি একজনের ছবিকে অন্যজনের মুখের সঙ্গে প্রতিস্থাপন করেও পর্নোগ্রাফির মতো এমন গর্হিত কাজ হরহামেশাই চলছে। পর্নোগ্রাফি আইন, ২০১২ এ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি তৈরি বা সরবরাহ করে, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। প্রায়ই দেখা যায় ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদিতে বিভিন্ন অবমাননাকর অশ্লীল ছবি প্রকাশ করা হয়। যার দ্বারা কোনো ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বিশেষ ব্যক্তির অবমাননা করা হয়। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় উগ্র রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতবাদ বা মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, দাঙ্গাহাঙ্গামা, অসাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র ও ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর প্রচার-প্রচারণা হরহামেশাই চলছে। এ ছাড়া চলছে সাইবার অপরাধের মধ্যে অন্যতম পরিচিত অপরাধ ফেসবুকে বিভিন্ন আপত্তিকর ছবি ছড়ানো, ভিডিও শেয়ার, আজেবাজে মন্তব্য এবং অসৎ উদ্দেশ্যে অন্য নামে আইডি ব্যবহার করার মতো ভয়াবহ কাজ। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন তথা (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত ২৫৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে; যার অধিকাংশই ফেসবুক সংক্রান্ত। জরিপে আরো বলা হয়েছে, এর ভুক্তভোগীরা শতকরা ৬৮ জনই নারী। আর অপরাধের ধরন হচ্ছে ফোনকলের মাধ্যমে হুমকি দেওয়া, কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন, পণ্য বেচাকেনার ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার, গ্রাফিকসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফিতে ও অনলাইন গেমসে আসক্ত করা, ছবি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ব্যক্তির মানহানি ঘটানো ইত্যাদি। ইন্টারনেটের তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় বিশ্বে ৭০০ মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে হ্যারেজমেন্টের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছে।। যদিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধ, কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে সংগঠন করে বা করার চেষ্টা করে, তাহলে সে অনধিক ১৪ বছর কারাদন্ড ও অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এখন প্রশ্ন হলো- আইনে শাস্তির এত কঠিন বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন সংঘটিত হচ্ছে এমন অপরাধ? তাহলে কি দেশে আইনের প্রয়োগ নেই, নাকি জনগণ সচেতন নয়, কোনটা?

ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একদিকে দেশ যেমন উন্নত হচ্ছে, আধুনিকতার জোয়ারে ভাসছে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে দেশের যুবসমাজ যেন তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার অমানিশার অতল গহ্বরে। এখন সময় এসেছে দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সীমারেখা টানার। যেমন ১৮ বছরের নিচে বয়স হলে মোবাইল সিম কিনতে মা বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করতে হয়, ঠিক তেমনি ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারেও এমন বিধান করা যেতে পারে। পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদেরকে সন্তানদের বোঝাতে হবে তথ্যপ্রযুক্তির ভালো এবং খারাপ দিক সম্পর্কে। সন্তানরা যেন কখনো এর খারাপ দিকটির প্রতি আসক্ত হয়ে না পড়ে। তারা যেন তাদের মেধা ও বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসে, সে ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে। সরকারের দিক থেকে এটি ব্যবহারের একটি নির্দিষ্ট গন্ডি রাখতে হবে। যেন এর খারাপ দিকটিতে সহজেই কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সর্বোপরি সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে এ অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। পরিশেষে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে এবং এর নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ অপরাধ কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা রাখি।

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close