মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

  ০১ মার্চ, ২০২১

দৃষ্টিপাত

তারুণ্যের শক্তি বয়ে আনবে সমৃদ্ধি

বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অর্জিত প্রবৃদ্ধিই প্রমাণ করে এ দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস যেন হঠাৎ আসা ঝড়ের মতো সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। শিগগিরই পুনরুদ্ধারের আশা অতিক্ষীণ। নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতির ওপর। তবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে শুধু করোনাভাইরাস নয়, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আঘাতেও অর্থনীতি বিপর্যস্ত। বাংলাদেশ তিনটি ধাক্কা সামলেও সামনে এগিয়েছে। এটা টিকে থাকার পুরোনো সক্ষমতার প্রমাণ। চারদিকে শুধু অর্থ, সম্পদ আর উন্নয়নের ছড়াছড়ি। কিন্তু মূল দৃশ্যের আড়ালেই আছে দুর্নীতি, দারিদ্র্য বেকারত্ব, বৈষম্যসহ অসংখ্য বেমানান দৃশ্য। করোনায় অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব পড়ায় দারিদ্র্য বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, জুলাই শেষে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে; যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ২০ শতাংশ। অন্যদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, দারিদ্র্যের হার এখন ৩৫ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২১ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম-এর জরিপ অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। পাশাপাশি দেশে আয়বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৫২ পয়েন্ট; যা ২০১৬ সালে ছিল দশমিক ৪৮ পয়েন্ট। বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে। এটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। কোভিডের আগে দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশ বেশ ভালো করছিল; কিন্তু কোভিডের ধাক্কায় সে অবস্থা আর নেই। এখন মানুষের আয় কমে গেছে। বহু মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। আগের বেকার সমস্যা তো রয়েছেই। গত দেড় দশকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি দিন দিনই কমছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কর্মসংস্থান কৌশলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০০২-০৩ থেকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরের মধ্যে প্রতি বছর ২ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান বেড়েছে। পরের পাঁচ বছরে তা বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ হারে। ২০১০ সালের পরের তিন বছর ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে, পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩-১৭ সাল পর্যন্ত তা কমে হয় ১ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। ওপরের পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ হলেও এই প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থানহীন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। আর শতাংশের হিসেবে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। শুনতে অবিশ্বাস্য শোনালেও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী বেকারত্বের এই পরিসংখ্যানই ব্যবহার করে যেতে হবে। আইএলওর বেকারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কাজপ্রত্যাশী হওয়া সত্ত্বেও সপ্তাহে এক দিন এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজের সুযোগ না পেলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হবে। এই সংজ্ঞাটা উন্নত দেশের জন্য যতটা প্রযোজ্য, বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে ততটা হওয়া উচিত নয়। কারণ উন্নত দেশে সপ্তাহে দু-এক দিন কাজ করেও জীবনধারণ করা সম্ভব এবং বেকার জনগোষ্ঠী সরকারের কাছ থেকে ভাতা পেয়ে থাকে। আমাদের দেশে জীবনধারণের জন্য কোনো না কোনো কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। আবার বাংলাদেশে প্রায় ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেতন-ভাতা নির্ধারণের কোনো নিয়ম নেই। সর্বশেষ প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, ২০১৩-১৭ সাল এই চার বছরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২৭ লাখ। অর্থাৎ বছরে গড়ে পৌনে সাত লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২২ লাখ নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে যত লোক চাকরি বা কাজ করেন তাদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ আত্মনিয়োজিত। গৃহস্থালি পর্যায়ে কাজ করেন ২০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কাজ করেন মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। আর এনজিওতে আছেন দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রায় দুই কোটি নারী-পুরুষ এই খাতে কাজ করেন এবং গত ৫ বছরে গড়ে ১০৫ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) বলছে, করোনার কারণে শুধু পোশাক খাতে তিন লাখের মতো কর্মী কাজ হারিয়েছেন। যাদের শিগগিরই কাজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা অতিক্ষীণ। আইএলও বলছে, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। করোনার কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে।

এবার দেখা যাক প্রবাসী আয়ের চিত্র, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের একের পর এক রেকর্ড গড়েছে। সেই বিদেশে যাওয়ার পথ প্রায় একেবারেই বন্ধ। উপরন্তু মহামারি আতঙ্কে গত বছর লাখ লাখ বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই ফিরে যেতে পারেননি আগের কর্মস্থলে। তবু কেন এই প্রবাসী আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি, যা বিশ্বব্যাংকের আগেকার পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, দেশের প্রবাসী আয় ২২ ভাগ কমে ১৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে। অথচ সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বিদায়ী ২০২০ সালে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা; যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি এবং ২০১৯ সালের তুলনায় ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালে এসেছিল ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার। এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান বন্ধ, সরকারি প্রণোদনার ফলে অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে আনুষ্ঠানিক খাতে টাকা আসা। তবে এ বছর ২০২১ সালে প্রবাসী আয়ে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করবে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল। এ সময় ১০ দশমিক ৯ ভাগ কমে যেতে পারে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এর বাইরে থাকবে না বাংলাদেশ। সুখবর নেই রপ্তানি খাতেও, যার সিংহভাগই দখল করে আছে পোশাক রপ্তানি খাত। করোনার শুরুতে ক্রয়াদেশ বাতিল ও কারখানা বন্ধ থাকায় গত এপ্রিলে পণ্য রপ্তানিতে ধস নামে। ওই মাসে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ধীরে ধীরে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করার মধ্যেই করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে বিপর্যস্ত করেছে। এর ফলে নতুন করে লকডাউনের দিকে যাচ্ছে অনেক দেশ। ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। নতুন ক্রয়াদেশও আসছে কম। আবার কারখানা বন্ধ হয়ে এ খাতে শ্রমিকদের নতুন করে কর্মহীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে চাকরি, শ্রমবাজার কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের পুরো ব্যবস্থাই প্রায় ধসে পড়েছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে উদ্যোক্তারা রীতিমতো যুদ্ধ করছেন। আয় কমে যাওয়ায় সরকারও ব্যয় কমিয়ে আনছে। ফলে কাজের বাজার নিয়ে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।

সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চাকরি প্রত্যাশীত তরুণরা। জীবন ও জীবিকার লড়াইয়ে আজ তারা পুরোপুরি হতাশায় নিমজ্জিত। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবন যেন তাদের দিন দিন অস্থির করে তুলছে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। তরুণরাই একটি দেশের প্রধান চালিকাশক্তি ও ভবিষ্যৎ নির্মাতা। তাইতো এই বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মবিমুখ রেখে কখনোই দেশে টেকসই অর্থনীতি আশা করা যায় না। এই মহামারিতে দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ধরে রাখতে তথা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কর্মসৃজনমূলক কর্মসূচি নিতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তার সুফল সবাই পাচ্ছে না। বিশেষ করে এসএমই খাতের উদ্যোক্তা প্যাকেজের সুবিধা নিতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকও সহযোগিতা করছে না। এসব বিষয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের তরুণদের অদক্ষ ও সস্তা শ্রমের বাজার থেকে বের হয়ে নিজেদের দক্ষ, জ্ঞান-বিজ্ঞানসমৃদ্ধ, স্মার্ট জাতিতে পরিণত হতে হবে। এজন্য প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক, যুগোপযোগী আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদামাফিক শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে একটা বিষয়ই অপরিবর্তনীয় আর সেটা হলো পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের হাত ধরেই পৃথিবীর এত অগ্রগতি। এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় অথবা নিউ নরমাল লাইফে যে দেশ যত দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারবে, তাদের অর্থনীতিও তত দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানবসভ্যতায় প্রতিটি বিপর্যয়ই কোনো না কোনো সুযোগ নিয়ে আসে। সেই সুযোগটিই সবার আগে তরুণদের উদ্ভাবনী জ্ঞান দিয়ে খুঁজে বের করতে হবে। নতুন আইডিয়ার ওপর ভর করেই পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের নিজস্ব কোনো কন্টেন্ট নেই, আলিবাবার কোনো পণ্য নেই, কোনো গাড়ি নেই উবারের। তার পরও এগুলো মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। সারা বিশ্বে আজ হাইটেক ব্যবসা-বাণিজ্যের জয়জয়কার। তাইতো তরুণদের পুরোনো ধ্যাণধারণা থেকে বের হয়ে নতুন নতুন আইডিয়া কাজে লাগিয়ে বিশ্বে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। তরুণদের লেগে থাকার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সামনের এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে দক্ষতা দিয়ে টিকে থাকতে হবে। হতাশা কখনোই সফলতা বয়ে আনে না। হাল ছাড়া যাবে না। জাতির নেতৃত্ব দিতে হবে তরুণদেরই। পৃথিবীতে আজ যত উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ সব এই তরুণদের হাত ধরেই। নানা চড়াই-উতরাই পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এই বাংলাদেশ। আর তরুণরাই পারবে এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে; যা বাংলাদেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।

লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close