ইসমাইল মাহমুদ

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

স্মরণ

মুক্তচিন্তক সৈয়দ আবুল মকসুদ

সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন দেশের বিশিষ্ট মুক্তচিন্তক সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট, গবেষক, জাতীয় তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ রক্ষা আন্দোলনের নেতা, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, টেলিভিশনের টকশোর সুবক্তা, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শুভ্রবসনের সৈয়দ আবুল মকসুদ। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বজনরা তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক সন্ধ্যা ৭টার দিকে সৈয়দ আবুল মকসুদকে মৃত ঘোষণা করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যুতে দেশ একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে হারাল। মুক্তবুদ্ধিচর্চার মাধ্যমে জাতিকে আলোকিত করতে সৈয়দ আবুল মকসুদের অবদান অবিস্মরণীয়। তার মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্য অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলো। এ ক্ষতি অপূরণীয়। তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতা অঙ্গনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটল। সৈয়দ আবুল মকসুদের দেহের মৃত্যু ঘটলেও তিনি দেশপ্রেমিক মানুষের হৃদয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন তার লেখনী দিয়ে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ও মা সালেহা বেগম। তার জন্মের দুই বছর পর ১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর তার মা আরেক সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ধনুষ্টঙ্কার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর বিমাতা বেগম রোকেয়া আখতার তাকে নিজ গর্ভজাত সন্তানের স্নেহে লালন-পালন করেন। তিনিও ১৯৮০ সালে মারা যান। তার বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ কাব্যচর্চা করতেন। তাই শৈশব থেকে তিনি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান।

সৈয়দ আবুল মকসুদের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি তাদের বাড়ির নাপিত লোকনাথ শীলের কাছে। লোকনাথ শীল তাকে ‘বর্ণবোধ’ ও ‘আদর্শলিপি’র পাঠ দিতেন। এরপর তিনি শিক্ষা লাভ করেন ডাক্তার নিবারণ চন্দ্র সাহা পোদ্দারের কাছে। তিনি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন আনন্দমোহন হাইস্কুলে। সেখান থেকে মেট্রিক পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক নবযুগ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থিত সাপ্তাহিক ‘জনতা’য় কিছুদিন কাজ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশ বার্তা সংস্থা (বাসস)-এ যোগ দেন। বাসস-এ উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে ২০০৪ সালের ১ মার্চ বহুল প্রচলিত দৈনিক পত্রিকায় ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত-ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর বাসসের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ সৈয়দ আবুল মকসুদকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করার জন্য কড়া ভাষায় নির্দেশ দেয়। এর পরদিন ২ মার্চ চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকারে সৈয়দ আবুল মকসুদ বাসস থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় তিনি লেখালেখিতে আরো অধিক সক্রিয় হয়ে উঠেন। তার সমসাময়িক বিষয়াবলি নিয়ে লেখা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। দৈনিক প্রথম আলোতে ‘সহজিয়া কড়চা’ এবং ‘বাঘা তেঁতুল’ শিরোনামে তিনি সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কলাম লিখে গেছেন দীর্ঘদিন। তার লেখা কলাম ও প্রবন্ধগুলো দেশের রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় সাধারণ মানুষদের। তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবনী ও কর্ম নিয়ে অসংখ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে সাহিত্যানুরাগীদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সৈয়দ আবুল মকসুদ।

লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদের যাত্রা হয় ষাটের দশকে। তিনি দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখতেন। ১৯৮১ সালে তার প্রথম কবিতার বই ‘বিকেলবেলা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিত’। এ গ্রন্থে তিনি মানবাধিকার, পরিবেশ, সমাজ ও প্রেম নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ক্ল্যাসিকধর্মী গবেষকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তার লেখায় স্বপ্ন বুনেছেন দিনবদলের। বামধারার অনুসারী সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা প্রবন্ধগুলো দেশ ও সময়ের প্রয়োজনে হয়ে উঠে একেকটি ইতিহাস। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ প্রখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের জীবনী ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। জীবদ্দশায় সৈয়দ আবুল মকসুদের চল্লিশের ওপর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলোÑ কবিতা : ‘বিকেলবেলা (১৯৮১)’, ‘দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৮৭)’, ‘সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা (২০১২)’, ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার’। প্রবন্ধ : ‘যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা (১৯৮৮)’, ‘গান্ধী, নেহেরু ও নোয়াখালী (২০০৮)’, ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু (২০১১)’, ‘রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, প্রভৃতি (২০১২)’, ‘প্রতীচ্য প্রতিভা’, ‘কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলি’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’, ‘অরণ্য বেতার’, ‘বাঙালি জাতি বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘রাজনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতি’, ‘রবীন্দ্র রাজনীতি’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’। জীবনীগ্রন্থ : ‘মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর জীবন, কর্মকান্ড, রাজনীতি ও দর্শন (১৯৮৬)’, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য (২০১১)’, ‘ভাসানী কাহিনি (২০১৩)’, ‘গান্ধী মিশন ডায়েরি’, ‘স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (২০১৪)’, ‘পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’, ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ দার্শনিক’, ‘হরিশচন্দ্র মিত্র’, ‘পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রুন্নেসা খাতুন’, ‘গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘর-গেরস্থালি’, ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরী জীবন ও সাহিত্য’। ভ্রমণকাহিনি : ‘জার্নাল অব জার্মানি’, ‘ভ্রমণ সমগ্র’, ‘পারস্যের পত্রাবলি’।

কলাম সংকলন : ‘সহজিয়া কড়চা’। সৈয়দ আবুল মকসুদ ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে সালে সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

সৈয়দ আবুর মকসুদের প্রয়াণে কষ্টে বুক ভারি হয়ে উঠেছে দেশের অগণিত মানুষের। তিনি কারো একার ছিলেন না। তিনি ছিলেন অনেকের। তার মৃত্যু সংবাদে দেশের সাংবাদিকতা, সাহিত্য অঙ্গনের মানুষের হৃদয় ও মন বিষণœতায় বলে উঠেছে। আমাদের বিশ্বাস, সৈয়দ আবুল মকসুদ যেখানেই থাকুন না কেন, ভালো থাকবেন। আর থাকবেন আমাদের স্মৃতিপটে।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close