অনন্য প্রতীক রাউত
পর্যালোচনা
ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা জরুরি
রাজপথের তাজা রক্ত, সংগ্রাম কিংবা ত্যাগের অপার সম্মিলন বাংলা ভাষা। শোষণের নামে ভাষার ওপর আঘাত নেমে এলেও বাঙালিরা দমে যায়নি। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বাররা দেখিয়েছেন পথ। আজ আমরা পারছি স্বাধীনভাবে কথা বলতে ঠিকই, তবে প্রতিনিয়ত এক প্রকার গলাটিপে বিকৃত করছি বাংলা ভাষাকে। এক দিন অপমানবোধ থেকে এই জাতি ঢেলে দিয়েছিল তাজা রক্ত, আর আজ সেই জাতিই কি না অপমানহীনতায় নির্লজ্জের মতো অপমানিত করে চলেছে নিজেদের।
রাস্তা দিয়ে চলাফেরার সময় সাইনবোর্ডের অশুদ্ধ বানান, বাংলিশ শব্দচয়ন, উচ্চশিক্ষায় পুরোপুরি ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া, সময়ের সঙ্গে টিকে থাকতে সরাসরি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের গন্ডিতে ঢুকে পড়া, স্বাভাবিক কথাবার্তায় বাংলিশ (বাংলা, ইংরেজির সংমিশ্রিত রূপ) ব্যবহার আমাদের নিত্যদিনের পরিচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুগের সঙ্গে টিকে থাকতে অবশ্যই ইংরেজি ভাষা জানার দরকার আছে, তবে তা কি মাতৃভাষা শিক্ষার পথকে রুদ্ধ করে দিয়ে? নিজের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে অতি লাভের আশায় বিপথগামী হওয়াটাকে আধুনিকতা বলে না।
বর্তমান সময়ের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, আধুনিক গান এবং ওয়েব সিরিজে হাস্যরস বাড়ানোর নামে যুক্ত করা হচ্ছে অশ্লীল সংলাপ, বাংলিশ বিকৃত নানা শব্দ। ফেসবুক, ইউটিউবের সহজসাধ্য প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে অনেকেই হয়ে উঠছেন সেলিব্রিটি। জনপ্রিয়তা ধরে রাখার স্বার্থে তারা এসব বিষয়কে উসকে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তরুণ প্রজন্মের বিকৃত একটি অংশ সেগুলোতে মাতোয়ারা, বাকিরা সুস্থতার খোঁজে ভক্ত হয়ে যান ভিনদেশি সংস্কৃতির। সবকিছুর বেড়াজালে নিয়মিত বিকৃত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই বিষয়গুলো আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বাকিটা সময় স্রোতের তালে আমরাও হারিয়ে ফেলি নিজের বিবেককে, অস্তিত্বকে। বাংলা ভাষা খাদের কিনারায় অবস্থান করছে এটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কিছু নেই। এই দূরাবস্থা থেকে উত্তরণ খুবই জরুরি। কীভাবে তা সম্ভব?
কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, মাতৃভাষার চর্চা কীভাবে বাড়ানো যায়? অনেকেই হয়তো বলবেন সব ক্ষেত্রে ভাষাকে ব্যবহার করা। কিংবা অন্য ভাষার প্রভাব থেকে মাতৃভাষাকে মুক্ত রাখা। কিন্তু আমাদের বাঙালিদের ক্ষেত্রে এটা একটু অসম্ভবই বটে! এক সমীক্ষাতে বেরিয়ে এসেছে আমরা বাঙালিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক মিনিটও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারি না। এটা কি আমাদের জন্য লজ্জাজনক নয়? আবার অনেকে বলতে পারেন ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ড বা ফেস্টুনগুলো ভেঙে দিলে হয়তো মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা পাবে। আবার অনেকে বলবেন, শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজির প্রাধান্য কমানো। তা হলে কি সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে পারব আমরা? সবাই বলবেন, কখনোই সেটা সম্ভব নয়। তাহলে উপায় কী?
প্রকৃতপক্ষে, এভাবে সংস্কৃতি রক্ষা করা যায় না, যায়নি কোনো সময়ই। হিটলার পারেননি, রোমান সম্রাটও পারেননি, পাক হানাদার পশুরাও পারেনি। আমরা ভাষা নিয়েও উগ্রপিন্থ হতে দুই মিনিট সময় নেই না। সংস্কৃতির বিকাশ হয় সৃজনশীলতার মাধ্যমে, ধ্বংসাত্মক মানসিকতা হীনম্মন্যতার লক্ষণ। নিজের ভাষাকে ভালোবাসার অর্থ এই না যে, অন্যের ভাষাকে ঘৃণা করতে হবে। এটা স্পষ্টভাবে বলা যায়, ভাষার বিকাশ হয় সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে। অন্যভাষাকে অশ্রদ্ধা করার মাধ্যমে কখনোই নয়। আলোচনার সারমর্ম একটাইÑ আধুনিকতার নামে ভিনদেশি সংস্কৃতিচর্চায় আজ মত্ত তরুণ সমাজ। বিশেষত ভিনদেশি টিভি সিরিয়াল বা ওয়েব সিরিজের গল্প থাকে বর্তমান সময়ের তরুণদের মুখে মুখে। বাংলা ভাষায় রুচিসম্মত নাটক, সিনেমা বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নির্মাণ না হওয়াই যার কারণ। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা এবং সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই, যা বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তাকে কমিয়ে দিচ্ছে। সর্বোপরি ভাষাকেন্দ্রিক সচেতনতা, আবেগ কিংবা নিজস্ব সংস্কৃতিবোধের জায়গাটি নিশ্চিত করতে পূর্বসূরিদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। হোক প্রতিজ্ঞা- যে মুখে মা বলব, সে মুখেই মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষা করব।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
"