অরূপ তালুকদার
মুক্তমত
প্রয়োজন কঠোর তদারকি
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমন নিশ্চয়ই নয়, যেমন আমাদের দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষকে অনেকটা জিম্মি করে রেখেছে। এমনকি তাদের জীবনযাত্রাও রীতিমতো অস্থিরতায় ভরে দিয়েছে।
এসব প্রভাবশালী বিত্তবান ব্যবসায়ী সাধারণত কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না। একসময় তারা ভর করেছিল পেঁয়াজ ব্যবসায়, তারপর ভোজ্য তেল, চাল, ডাল ইত্যাদি দৈনন্দিন পণ্যদ্রব্যে। জীবনযাত্রা চালানোর জন্য সাধারণ মানুষের যা যা প্রয়োজন তার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের অবৈধ কারসাজিতে রীতিমতো বিপদে ফেলেছে দেশের কোটি কোটি মানুষকে।
বিগত ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে চাল নিয়ে তারা যে তেলেসমাতি দেখিয়েছে, তার কোনো তুলনা নেই। দিনের পর দিন তারা সব ধরনের চালের দাম কমবেশি করে বাড়িয়েছে। কারোর কোনো কথা শোনেনি, পাত্তাও দেয়নি। সরকারি সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে চাল আমদানির ঘোষণা দিয়ে তিনবারে ১৮৫টি প্রতিষ্ঠানকে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। বলা যায়, এই ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চালের বাজারের চেহারা পাল্টে যেতে শুরু করে।
বর্তমানে বস্তাপ্রতি চালের দাম কমেছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, আমদানি করা চাল বাজারে এলে দাম আরো কমে যাবে। এভাবে চালের দাম কমে আসায় প্রশ্ন উঠেছে, মিল-মালিকরাই কি তাহলে এত দিন চালের মূল্যবৃদ্ধি ও কমার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে? কারণ এত দিন তারা বলে আসছিল দেশে ধানের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই, তাই দাম বেড়েছে। আর ধানের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দামও বেড়ে গেছে। কিন্তু চাল আমদানির খবরে হঠাৎ করে দাম কমে যাওয়ায় পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলেছেন, এখন মিল-মালিকরা কীভাবে চালের দাম কমাতে পারল? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে চাল আমদানির খবরে পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরা বাজারে তার প্রভাব পড়েছে সামান্যই। বেশির ভাগ বাজারেই এখনো পুরোনো মূল্যই বহাল রয়েছে। বাজারে মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৬২ থেকে ৬৫ টাকা, নাজিরশাইল ৬০ থেকে ৬৩, বিআর ২৮ চাল ৫৩ থেকে ৫৫ এবং মোটা স্বর্ণা মানভেদে প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় এখনো বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে ভোজ্য তেল, বিশেষ করে সয়াবিন তেলের মূল্যও বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এ ক্ষেত্রেও ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় অজুহাত, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের মূল্য বেড়ে গেছে। বলাবাহুল্য, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের মূল্য কখন কতটা বাড়ে বা কমে তার খবর স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। তবে এসব খবর যাদের নেওয়ার কথা অর্থাৎ সরকারিপর্যায়ে আমদানি-রপ্তানি বিষয়ে যাদের খবর রাখতে হয় এবং নিয়মিত মনিটরিং করতে হয়, তারা কী করেন? তারা কি সত্যি কোনো খবর রাখেন যে, যারা ভোজ্য তেলের বড় বড় ব্যবসায়ী তথা আমদানিকারক, তারা তাদের ব্যবসার খাতিরে কতটা সত্যি বা মিথ্যা বলছেন?
সাধারণ মানুষও জানে, আগে যখন অনেক টালবাহানা করে সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারে ৩ বা ৪ টাকা মূল্যবৃদ্ধি করা হতো, তাও করতে হতো সরকারের সঙ্গে অনেক যুক্তিতর্ক শেষে নানা রকম কৌশল খাটিয়ে। কিন্তু সেই ১০০ থেকে ১০৫ টাকা লিটারের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা এবং খোলাবাজারে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা প্রতি লিটার ও এর পাশাপাশি পামতেল বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা প্রতি লিটার।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এসব ক্ষেত্রে সরকারি বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা এত দুর্বল হয়ে পড়ল কেন? বাজার মনিটরিংয়ের বেহাল অবস্থা আমরা অবশ্য পেঁয়াজ ও অন্যান্য পণ্যের সংকটের সময়ও দেখেছি, এখনো দেখছি। এটা নতুন কিছু নয়।
ভারত গত পহেলা জানুয়ারি থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেঁয়াজের দাম পড়ে যেতে থাকে, এখন যা অনেকটা স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। তবে স্থিতিশীল হওয়ার অবশ্য আরো একটি বড় কারণ রয়েছে, তা হলো বেশ কিছুদিন আগে থেকেই দেশি পেঁয়াজে বাজার সয়লাব হয়ে আছে, বিভিন্ন বাজারে যা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে।
এদিকে চাল ও ভোজ্য তেলের পরে নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে চিনির দাম। দেশে এখন সম্ভবত ৫৬টি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত ভোজ্য তেল ও চিনি আমদানি করে পরিশোধনের পর বাজারজাত করে থাকে। স্বাভাবিকভাবে বাজার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্বভাবত তারাই হয় প্রভাবশালী। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এদের সবচেয়ে বড় অজুহাত বা কৌশলটি হচ্ছে বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেল ও চিনির দাম বেড়ে যাওয়া। কয়েক মাস ধরে এই কৌশলটিই তারা কাজে লাগিয়ে পণ্য দুটির দাম বাড়িয়ে চলেছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ অর্থাৎ টিসিবির তালিকা অনুযায়ী খুচরা দোকানে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে, যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা দরে। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির হাওয়া লেগেছে শীতকালীন শাকসবজির বাজারেও। অথচ শীতকালীন শাকসবজি ও তরিতরকারির বাজার থাকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নাগালের মধ্যে। এই করোনাকালের দুঃসময়ে ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সে সুযোগটিও কেড়ে নিয়েছেন। তবে সপ্তাহ তিনেক আগের চেয়ে এখন দাম কিছুটা কমেছে। তবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কখন আবার কোন অজুহাতে দাম বেড়ে যাবে। হয়তো এখন তারা ঘন কুয়াশা পড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন!
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যশোরের বারীনগর এলাকার পাইকারি হাটবাজার এবং মোকামে শিম, বেগুন এবং কপি বেচাকেনা হচ্ছে তিন থেকে চার টাকা কেজি দরে। পাশাপাশি বাঁধাকপি দুই টাকা, ফুলকপি তিন টাকা, মিষ্টিকুমড়া দশ টাকা, নতুন পেঁয়াজ ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর ফলে এসব শাকসবজি ও তরিতরকারি উৎপাদনকারী সাধারণ কৃষকরা রীতিমতো হতাশায় ভুগছেন। কারণ এখন যে বাজার চলছে তাতে তাদের উৎপাদন খরচই উঠবে না।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে স্থানীয় কৃষকরা শীতকালীন সবজি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই আমরা অন্য কোনোভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। কারণ সবজি উৎপাদন থেকে কৃষকরা মুখ ঘুরিয়ে নিলে শুধু কৃষকরাই নন, সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে।
যশোর এবং তার আশপাশের অঞ্চলের কৃষকরা বলেছেন, শাকসবজি উৎপাদনবান্ধব এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন। কারণ তাদের কাছাকাছি এ ধরনের হিমাগার থাকলে তারা আলুর মতো শাকসবজিও বেশি সময়ের জন্য সংরক্ষণ করতে পারবেন এবং কোনো দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা তাদের জিম্মি হতে হবে না।
স্থানীয় কৃষকরা আরো বলেছেন, সাধারণত শীতকালীন শাকসবজি ও তরিতরকারির জন্য ডিসেম্বর মাসই গুরুত্বপূর্ণ এবং বেচাকেনার জন্য ভালো সময়। এই সময়টিতে পাইকারি দাম বেশ ভালো থাকে। এরপর প্রায় দুই মাস শাকসবজির দাম ধীরে ধীরে পড়ে যায়। তখন উৎপাদন খরচও উঠতে চায় না।
কৃষিবিষয়ক অভিজ্ঞজনদের ধারণা, এসব পণ্যের বাজারদর নির্ধারণ করে থাকে সাধারণত পাইকারি বাজারে বিচরণশীল মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা খুবই প্রভাবশালী এবং পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী। কিন্তু তার পরও যেহেতু আমাদের দেশ এখনো মূলত কৃষিপ্রধান, তাই যেকোনো মূল্যে কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখা একান্তই জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"