সাহাদাৎ রানা

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২১

মুক্তমত

করোনার চেয়েও ভয়াবহ সড়কে মৃত্যু

বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে করোনার ভয়। সেদিন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আর প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার ৯০০-এর বেশি মানুষ করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। সময়ের হিসাবে ১০ মাসের পরিসংখ্যানের তথ্য এটি। মহামারিতে এত মানুষের মৃত্যু সত্যিই অপ্রত্যাশিত। করোনায় মৃত্যুর খবরের মধ্যে আরো একটি মৃত্যুর খবর আমাদের সবাইকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তুলছে। বিষয়টি হলো সড়ক দুর্ঘটনা। কারণ প্রতিদিন সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। গত ৬ জানুয়ারি নিরাপদ সড়ক চাইয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪ হাজার ৯৬৯ মানুষ। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৫ জন। করোনাকালীন এমন সময়ে মানুষের চলাচলা কম থাকার পরও সড়কে এত মৃত্যুর সংখ্যা সবাইকে আরো বেশি করে ভাবিয়ে তুলছে। অবশ্য শুধু করোনাকালীন নয়, সারা বছরই আমাদের দেশে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যায় সড়কে। করোনার মতো আমাদের জন্য সড়ক দুর্ঘটনাও একটি ভয়াবহ ভাইরাস। যে ভাইরাস দিন দিন আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।

এখন প্রশ্ন হলো, দেশে কেন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা? কেন থামছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে অতীতে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু কেন? বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো চালকদের অসর্তকতা ও দক্ষতার অভাব। দীর্ঘদিন ধরেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কঠোর আইনের দাবি উঠে আসছিল। সেই দাবির আলোকে ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এই আইন কার্যকরের পরও এর সুফল আমরা পাচ্ছি না। আমাদের দেশের বাস্তবতায় নিত্যদিনের যাত্রায় মানুষের নির্ভরতা সড়ক পথেই বেশি। দেশের প্রধান যোগাযোগমাধ্যমও সড়কপথ। কিন্তু সেই সড়কপথ অনিরাপদ। যাত্রী পরিবহন থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন সব ক্ষেত্রে সড়কপথের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই সড়কপথে সবচেয়ে বেশি শৃঙ্খলা ও নিরাপদ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা দেখছি তার উল্টো চিত্র। আমাদের সড়ক পথে নিরাপত্তা নেই, নেই শৃঙ্খলা। এর প্রভাবে সড়কে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনা। নতুন আইন করার পরও সড়কে দুর্ঘটনা না কমার বিষয়টি দুঃখজনক। পাশাপাশি হতাশারও। কারণ এই আইনের পরও বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন সড়কে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে এবং এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, আমাদের দেশের বাস্তবতায় শুধু আইন কার্যকর করলেই হবে না। এর পাশাপাশি কিছু উদ্যোগও নিতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ সড়কে চলাচলের পরিবেশ, অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, চালকের অসতর্কতা, সড়ক নির্মাণে প্রকৌশলগত ত্রুটি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থার মধ্যে দায়িত্ব পালনে অনীহা, চালকদের মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানো, যানবাহন ও সড়ক ব্যবহারকারী তথা চালক, যাত্রী, পথচারীসহ সবার অসচতেনতার বিষয়গুলো প্রধান। এ ছাড়া দেখা যায় দেশের সব মহানগরে যত পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তার দ্বিগুণের বেশি মারা যান শুধু ঢাকা মহানগরে। এর পেছনেও রয়েছে অনেকগুলো কারণ। প্রধান কারণ ঢাকায় মানুষ ও যানবাহন দুটোর সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি রয়েছে সব স্থানে জেব্রা ক্রসিং না থাকা, ফুটপাত না থাকা কিংবা অবৈধ দখলে চলে যাওয়া, স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থার অনুপস্থিতি ও পথচারী পারাপারে অব্যবস্থাপনার ত্রুটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

সড়কে নিরাপত্তা, সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। প্রায় দুই দশক ধরে বারবার আলোচিত হলেও এর সমাধান যেন আমাদের কাছে সব সময় সুদূর অতীত। অথচ আমাদের দেশে নিত্যদিনের যাত্রায় মানুষের নির্ভরতা সড়কপথেই বেশি। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের দেশে প্রায় সাত থেকে আট হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন সারা দেশে প্রায় ১৮ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। কারো কারো মতে অবশ্য সংখ্যাটা আরো বেশি। তবে মৃতের সংখ্যা নিয়ে তারতম্য থাকলেও, এটা সত্যিই সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশজ উৎপাদনে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। বিশেষ করে তরুণ ও কর্মক্ষম এই দুই শ্রেণিকে দেশের ভবিষ্যৎ ও অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগের চেয়ে বেশি মানুষই কর্মক্ষম। যাদের বয়স ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। নিহতের পরিবার এসব কর্মক্ষম মানুষকে হারিয়ে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়ে। তাদের মৃত্যুর কারণে পুরো পরিবারে দেখা দেয় এক ধরনের অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি শুধু পরিবার নয়, তাদের হারিয়ে দেশও হয় ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ কর্মক্ষম জনগণ যেমন পরিবারের জন্য সম্পদ, তেমনি দেশের জন্যও। সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণের অঙ্কটাও নেহাত কম নয়।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি আমাদের মতো দেশের জন্য সত্যিই অস্বস্তির খবর, যা মেনে নেওয়ার মতো নয়। কিন্তু তাই যেন আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। এখানে জনসাধারণেরও অনেকটা দায় রয়েছে। তাদের মধ্যেও সচেতনতা আসতে হবে।

এখন সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। তবে এটাও সত্যি, এ ক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের। সবার আন্তরিকতায় সম্ভব দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কপথ গড়ে ওঠা। করোনার মতোই সড়ক দুর্ঘটনাকেও একটি রোগের মতো ভাবতে হবে। যে রোগের প্রতিষেধক আমাদের নিজেদের হাতে। সবার সচেতনতায় সম্ভব সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close