নূরুননবী শান্ত

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২১

মতামত

নারীর জন্য নিরাপদ নাগরিকত্ব

সভ্যতা নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ দমনের মাধ্যমে মনুষ্যসমাজে শান্তি ও সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নিয়ম, নৈতিকতা ও বিচারব্যবস্থার উন্মেষ ঘটেছে। বৃহত্তর কল্যাণের প্রয়োজনে মানুষ তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রই হলো সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান, যার প্রধানতম কাজ প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা। তবে রাষ্ট্রসীমায় সংঘটিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণহীন ও বিচারহীন হলে কিছু মানুষের অপরাধমূলক আচরণ ক্রমবর্ধমান হারে প্রকাশ পায়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও, প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদের কাজ হলো এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। তা সম্ভব আইনের শাসনের মাধ্যমে। যদি এমন হয় যে, অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না, তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।’ সম্প্রতি বাংলাদেশে দুটি বড় অপরাধ ঘটে গেল। বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার ও প্রাণ হারাল ১৭ বছরের এক কিশোরী। তার ঠিক আগের দিন বাবা-মায়ের হাতে নিহত হলো ১৭ বছরের এক কিশোর, যে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়েছিল নিজের বোনকে!

ধর্ষণ অপরাধ চিন্তাতীত অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। পুলিশের তথ্য মতে, চট্টগ্রামে ধর্ষণের শিকার ৬৬ শতাংশই শিশু-কিশোরী। শিশু-কিশোরীদের এমন নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পরিবারের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। কিশোর-কিশোরীরা শুধু অপরাধের শিকার নয়, অপরাধীও বনে যাচ্ছে অনেকেই। তাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার দায় পরিবারকে বহন করার চাপ প্রয়োগ করার মাধ্যমে আমরা কি কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারব? পরিবারগুলো কি আদৌ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাড়ন্ত বয়সের ছেলেমেয়েদের অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করার বা অপরাধ থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল শেখানোর সক্ষমতা রাখে? বাস্তবতা হলো, প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের প্রতিটি পরিবারের মা-বাবা ‘উন্নত জীবন’ অর্জনের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এর সঙ্গে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকা-সহ কোনো সৃজনশীল কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগও সীমিত, পারস্পরিক মতবিনিময় করার উন্মুক্ত স্থান নেই এ যেন শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য এক ‘নেই-রাজ্য’। তার ওপর কোভিড-১৯-এর ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং অন্যদিকে পরিবার বাঁচাতে মা-বাবাদের কাজ ও বাজারে যাওয়া বাধ্যতামূলক। ফলে, শিশু-কিশোর-কিশোরীরা ঘরে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে যে কোনোভাবে ঘরের বাইরে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। কেননা, বাড়িতে তাদের জন্য কথা বলার কেউ নেই! আর পরিবারের বাইরে তাদের নিরাপত্তা নেই, বিশেষ করে মেয়েদের। এমনকি পরিবারেও তারা নিরাপত্তাহীন! তাহলে, বাড়ন্ত বয়সের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে! কী করবে!

বিশ্নেষকরা বলেন, খেলাধুলার সুযোগ না থাকায়, বিদ্যায়তনে সংস্কৃতিচর্চার ব্যবস্থা, ডেমনস্ট্রেটিভ নৈতিক শিক্ষাকার্যক্রম, সর্বোপরি পারিবারিক তদারকি ইত্যাদি না থাকায় শিশু-কিশোর-কিশোরীরা মানসিক অসুস্থতাজনিত কারণে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, হত্যাকা-, মাদকাসক্তিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই ‘না-থাকাগুলো’ নিশ্চয় অল্প বয়সিদের অপরাধের চোরাগলির দিকে ধাবিত করে। তা কি মানসিক অসুস্থতাজনিত কারণে? আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী স্যামুয়েল ডি. স্মিথম্যান এবং শেরি হামবি ধর্ষকদের ওপর গবেষণা করে জানিয়েছেন, ‘এমন কোনো মানসিক রোগ পাওয়া যায়নি, যা ধর্ষণ করতে বাধ্য করে।’ সুতরাং, সার্বিক প্রেক্ষাপটের দিকেই নজর দেওয়া দরকার। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত জয়দীপ সরকারের আর্টিকেল জানাচ্ছে, ধর্ষকামী মানসিকতার ছয় রূপ সুযোগ-সন্ধানী : যারা সুযোগ পেলে ধর্ষণ-অপরাধ করে, স্যাডিস্টিক : ধর্ষণের মাধ্যমে নারী ও কন্যাশিশুকে সর্বোচ্চ আঘাত করে, প্রতিহিংসাকামী : প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়ে বা অন্যান্য প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে শোধ নিতে ধর্ষণ করে, কল্পনাপ্রবণ : ধর্ষণ করে বন্ধুমহলে বাহবা নিতে চায়, ক্ষমতালোভী : ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে ধর্ষণ করে এবং ক্ষুব্ধ : নারীর সাফল্য, সৌন্দর্য, হাসি সবই তাদের ক্ষুব্ধ করে। কোনো কোনো ধর্ষকের মধ্যে জয়দীপ একাধিক ধর্ষকামিতা থাকার কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশসহ ইউরোপ-আমেরিকার নগর-গ্রামে ধর্ষণ সম্পর্কে প্রচলিত মিথটি ভয়াবহ অপর পক্ষ যতই বারণ করুক বা বাধা দিক না কেন, বাস্তবে তারও এতে সম্মতি রয়েছেÑ মনস্তাত্ত্বিক অ্যান্তোনিও অ্যাবেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেছেন একজন ক্রমিক ধর্ষক। এ রকম ‘মিথজীবী’ মনুষ্য সম্প্রদায়ের অপরাধ নৈতিকতা দিয়ে ঠেকানো কঠিন। সম্প্রতি জার্মানির শিক্ষাবিদরা প্রমাণ করেছেন, সঠিক যৌন ও প্রজনন শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে ধর্ষকামিতা থেকে মুক্ত করা সম্ভব। ২০১৫ সালে ১০ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী জার্মানিতে প্রবেশ করার পর শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় ধর্ষণ অপরাধ বেড়ে যায়। তারপর, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সেখানে সরকার যৌন ও প্রজনন শিক্ষাকার্যক্রম বাস্তবায়ন করা শুরু করে। ফলাফল অত্যন্ত ইতিবাচক। দ্রুতই কমতে থাকে ধর্ষণ অপরাধ। বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে জানা যায়, তাদের বন্ধুদের আড্ডায় যৌনতাই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়!

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে অ্যাডভোকেট সালমা আলী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যৌনতা নিয়ে আমাদের সর্বত্র লুকোচুরি আছে। লুকোচুরির মধ্যে অপরাধ ঘটে।’ অথচ, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রচারমাধ্যম পর্যন্ত সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করার উপায় হিসেবে ব্যক্তিমানুষের নীতিনৈতিকতার ওপর আস্থা রাখতে চায়। আইনের বাস্তবায়ন ও সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে অপরাধ কমিয়ে আনার চিন্তা তাদের নেই। অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য অনেকেই আক্ষেপ করেন, ধর্ষকসহ বেশির ভাগ অপরাধী কোনো না কোনো ক্ষমতার প্রশ্রয়ে অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। জনগণও এই পার পাওয়ার সংস্কৃতি সহ্য করে যাচ্ছে। কেননা, প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাহীন ও ভীতসন্ত্রস্ত নিরীহ উপাদানের নাম জনগণ। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মুখেও শোনা যায়, জনগণ ভালো না, তাই সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ধর্ষণসহ অনেক অপরাধ দমন করা যাচ্ছে না! প্রাচীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর কথা মনে পড়েÑ জনগণ ভালো হলে রাষ্ট্রের দরকার হয় না। জনগণকে আইন ও তার কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে সঠিক পথে থাকতে সহায়তা করা অথবা বাধ্য করাই রাষ্ট্রের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ। অপরাধীদের প্রশ্রয়দানের সংস্কৃতি থেকে জাতিকে মুক্ত করে নারীর জন্য নিরাপদ নাগরিকত্ব প্রতিষ্ঠা করা মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আজকের বাংলাদেশে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close