জান্নাতুল মাওয়া

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২১

দৃষ্টিপাত

পরিবেশ রক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি

পরিবেশ বাঁচাতে এখন বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন এবং ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর। সমগ্র বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিবেশবান্ধব হওয়ায় ‘গ্রিন এনার্জি’ অথবা ‘ক্লিন এনার্জি’ নামে পরিচিত। আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। রূপকল্প ২০২১ অনুযায়ী দেশের সব নাগরিককে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। সর্বজনীন বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের অভিপ্রায়ে জ্বালানি বহুমুখীকরণকে বিদ্যুৎ বিভাগ অন্যতম কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। জ্বালানি বহুমুখীকরণের আওতায় প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিসি-৭) অন্যতম অভীষ্ট লক্ষ্য। বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় ২০২০ সাল নাগাদ উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরো বিশ্ব। একদিকে উন্নত বিশ্বের কার্বন নির্গমন অব্যাহত। আর অন্যদিকে দরিদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুর্ভোগ আর ঝুঁকি। তবে এর বাইরেও নেওয়া হচ্ছে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপের একটি হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার। নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রধান উৎসগুলো হচ্ছে সৌরশক্তি, হাইড্রো, বায়োগ্যাস, বায়োমাস, জিয়োথারমাল, ওয়েভ ও টাইডাল এনার্জি। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি। সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এ যাবৎ প্রায় ৩২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে, যার সিংহভাগই এসেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অফগ্রিড এলাকায় স্ট্যান্ড এলোন হিসেবে স্থাপিত সোলার হোম সিস্টেম থেকে। ইতোমধ্যে সোলার হোম সিস্টেমের প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে। কিন্তু প্রতি মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিন একরের অধিক ভূমির প্রয়োজন হওয়ায় বৃহৎ আকারের সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ভূমির সংস্থান দুরূহ। এ কারণে গ্রিডে সংযুক্ত বিভিন্ন স্থাপনা যেমন বাসাবাড়ি, শিল্প-কারখানার অব্যবহৃত ছাদে সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। ছাদে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান বৃদ্ধি পাবে। সোলার সিস্টেম স্থাপনের জন্য অনগ্রিড বিদ্যুৎ গ্রাহককে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে তা নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহিত করবে। অন্যদিকে অনবায়নযোগ্য জ্বালানি, যা তেল, কয়লা, গ্যাস ও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে উৎপাদিত হয়। উল্লেখ্য, তেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসগুলো একত্রে ‘ফসিল ফুয়েল’ নামে পরিচিত। সমগ্র পৃথিবীতে পরিবেশ বিপর্যয়ে সৃষ্ট চলমান করোনার মহামারি মোকাবিলায় ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের গুরুত্ব বাড়ানো উচিত।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৮৬০ সালে ফ্রান্সে প্রথম নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে সোলার এনার্জি আবিষ্কৃত হয়। পরে ১৮৭৬ সালে গবেষণায় দেখা যায়, সোলার প্যানেলে ব্যবহৃত সিলেনিয়াম সূর্য থেকে শোষিত শক্তিতে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ১৯২১ সালে সূর্যরাশ্মি কর্তৃক সোলার এনার্জি উৎপাদনে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৮৮৮ সালে বিশ্বে প্রথম নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে বায়ুচালিত ‘উইন্ড মিল’ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৩০ সালের দিকে সমগ্র আমেরিকায় উইন্ড মিলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে বিশের শতকের দিকে বায়ুচালিত উইন্ড মিল কর্তৃক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিস্তার সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। উইন্ড মিল কর্তৃক বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সমগ্র বিশ্বে ক্লিন এনার্জি নামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, সারা বিশ্বে ২০১৬ সালের দিকে বায়ুচালিত ৩ লাখ ৪১ হাজার ৩২০টি উইন্ড টার্বাইন চালু করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১৫ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ ওই উইন্ড মিলগুলোয় কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি ও স্থাপনে একটি বিনিয়োগ তহবিল গঠনের পরিকল্পনাও রয়েছে। এদিকে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক আইন অনুমোদন করল অস্ট্রেলিয়ার সেনেট। এই আইনের লক্ষ্য, ২০২০ সাল নাগাদ ২০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন। এই আইনের ফলে সবুজ জ্বালানি খাতে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত হলো।

জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম শিকার বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিক থেকে। জার্মানিসহ বেশ কিছু উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা এ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে বাংলাদেশকে। আর সরকারও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারে গ্রহণ করছে বেশ কিছু কর্মসূচি। বিশেষ করে জৈব গ্যাস এবং সৌরশক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয়ে উদ্বুদ্ধ করছে সারা দেশের মানুষকে। এমনকি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতি বিতরণ করা হয়েছে জনগণের মধ্যে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত জ্বালানিবিষয়ক সাময়িকী ‘এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার’-এর সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার এবং এর সংরক্ষণ এ দুটি বিষয় নিয়েই কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

সরকার এখন ভাবছে বায়ুর যে সম্ভাবনা, সেটা কাজে লাগানোর কথা। এ ছাড়া জৈব গ্যাসের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া কনজারভেশন অ্যাক্ট খসড়াপর্যায়ে আছে, এটা নিয়েও কাজ করছে সরকার। সঙ্গে সঙ্গে টেকসই জ্বালানি উৎপাদন কর্তৃপক্ষ গঠন করার জন্য কাজও এগোচ্ছে এবং এটায় সহায়তা দিচ্ছে জার্মান সরকার।

নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউটেড জেনারেশনকে উৎসাহিতকরণের লক্ষ্যে নেট মিটারিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নেট মিটারিং পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ গ্রাহক নিজ স্থাপনায় স্থাপিত নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক সিস্টেমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ নিজে ব্যবহার করে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ বিতরণ গ্রিডে সরবরাহ করেন। এভাবে সরবরাহ করা বিদ্যুতের জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল-পরবর্তী মাসের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। এ প্রক্রিয়ার ফলে গ্রাহকের বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয় হয়। এ পর্যন্ত প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের পঞ্চাশটিরও অধিক দেশে নেট মিটারিং পদ্ধতি চালু রয়েছে। বর্ণিত পরিস্থিতিতে, অনগ্রিড এলাকায় বিদ্যুৎ গ্রাহকদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে নেট মিটারিং সুবিধা দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ নেট মিটারিং পদ্ধতি বাস্তবায়ন নির্দেশিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

পরিবেশের বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশের মতো বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশে জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এমতাবস্থায়, বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোয় সমগ্র পৃথিবীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিবর্তে কয়লা, তেল, গ্যাস ও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি দৃশ্যমান। অন্যদিকে বিশ্বের কোনো কোনো দেশে বর্ধিত জনসংখ্যার বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত পারমাণবিক শক্তির জনপ্রিয়তা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। অনেক দেশ চলমান করোনার মহামারিতে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পারমাণবিক শক্তিতে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়। এমনকি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত পারমাণবিক শক্তির প্লান্ট থেকে রেডিও অ্যাকটিভ বর্জ্য পরিবেশে নির্গত হওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি লাগামহীনভাবে বেড়ে যায়। যা হোক, নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃক বায়ুম-লে ক্ষতিকর উপাদান নির্গত না হওয়ায় পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার সীমিত, তবু জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশ বিপর্যয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে সমগ্র বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সমগ্র বিশ্ব এখন চলমান প্রাণঘাতী করোনায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। এমতাবস্থায়, যদি বিষাক্ত ক্ষতিকর উপাদান বায়ুমন্ডলে বাড়তে থাকে, তাহলে মানবজাতির পরিবেশ বিপর্যয়ে অজানা অন্য কোনো মহামারির শিকার হওয়ার আশঙ্কাটি থেকে যায়। বিশ্বে যদিও পরিবেশ বিপর্যয়কে আলিঙ্গন করে অনবায়নযোগ্য জ্বালানির রাজত্ব বেড়েছে, তবু নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় অনবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারও বাড়াতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ময়মনসিংহ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close