রেজাউল করিম খোকন

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২১

আকাক্সক্ষা

আন্তর্জাতিক মানের নান্দনিক শহর কাম্য

ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কী হবে তেমন অশুভ চিন্তাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও কেন জানি পারি না। বারবার তাড়া করে ফিরে সেই ভয়ানক পরিস্থিতির কাল্পনিক চিত্র। ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যত মানুষ মারা যাবে, তার কয়েক গুণ বেশি মারা যাবে আগুনে পুড়ে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্টে। ভূমিকম্পের পর গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটবে। সেই আগুনে পুড়ে পুরো নগর দাউ দাউ করে জ¦লে উঠবে। ভূগর্ভস্থ পানি ও আশপাশের নদী জলাশয়ের পানি নগরে বন্যার সৃষ্টি করবে। উপড়ে পড়া বিদ্যুতের খুঁটির তারের সংস্পর্শে এসে সেই পানি বিদ্যুতায়িত হবে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে বিধ্বস্ত ঢাকা নগরীতে আক্রান্তদের উদ্ধারের লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। উদ্ধারকাজে সাধারণ সময়ে যারা মূল ভূমিকা রাখেন, সেই ফায়ার সার্ভিসের অস্তিত্ব থাকবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। রাজধানী ঢাকা শহরে তেমন আশঙ্কা বুকে চেপে রেখে আমরা দিন-রাত পার করছি।

দিন দিন রাজধানী ঢাকা আয়তন যেভাবে বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে জনসংখ্যা। বাড়তি মানুষের চাপে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। নানা সংকটে জর্জরিত নগরবাসীর নাভিশ্বাস চরমে উঠছে। যানজট, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট, মাদকের আগ্রাসন, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মশার উপদ্রব প্রভৃতি সমস্যাকে নিত্যসঙ্গী করে বসবাস করছেন সবাই। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত, বিত্তহীন, ছিন্নমূল বস্তিবাসী সবাইকে এক ধরনের অস্থিরতা, অতৃপ্তি, অশান্তি, অসন্তুষ্টি নিয়ে থাকতে হচ্ছে এই শহরে। এত সমস্যা, সংকট, অস্বস্তি, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার কথা জানার পরও প্রতিদিনই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে পা রাখছেন অগণিত নারী-পুরুষ। দারিদ্র্যের কারণেই যে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হন, তা বলা যায় না এখন। সচ্ছলতা থাকার পরও আজকাল অনেকেই গ্রাম কিংবা মফস্বল শহর ছেড়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং মানসম্মত জীবনযাপনের আশায় ঢাকায় চলে এসেছেন। গ্রামগুলো আগের চেয়ে অনেকটা উন্নত হলেও সামাজিক কাঠামোতে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন হয়নি। ভিলেজ পলিটিকস এখন আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। প্রাণহানি ঘটেছে, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। গ্রামীণ সমাজজীবনে অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে শহরে চলে আসছেন, বাসাভাড়া করে পরিবার-পরিজন নিয়ে উঠছেন। আবার সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষার ব্যাপারটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে কেউ কেউ শহরমুখী হচ্ছেন। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে গিয়ে রাজধানী ঢাকা বেসামাল একটি নগরীতে পরিণত হয়েছে, এ কথা সবাই স্বীকার করছেন।

রাজধানী ঢাকাকে একটি সুন্দর উন্নত মানের নগরী হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র। উভয়েই নগরবাসীকে জঞ্জাল, সংকট ও সমস্যামুক্ত একটি বাসযোগ্য চমৎকার পরিবেশ-সমৃদ্ধ নাগরিক জীবন উপহার দিতে নানামুখী চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের দৌড়ঝাঁপ নগরবাসীকে আশাবাদী করে তুলেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বাণিজ্যিক এবং আবাসিক এলাকায় ময়লা-আবর্জনা ফেলার হাজার হাজার ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়েছে। এখন কেউ আর যত্রতত্র ময়লা ফেলতে পারবেন না, পরিবেশ নোংরা করতে পারবেন না। করলে জরিমানা গুনতে হবে তেমন নির্দেশনা জারি করার পরও আমরা দেখছি যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে। অনেক জায়গায় স্থাপিত ময়লা-আবর্জনা ফেলার বিন চুরি করে নিয়ে গেছে চোর, তেমন ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যা দেখে মনটা গ্লানিতে ভরে গেছে। এই শহরে আমরা যারা বাস করছি, তাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে শহরটিকে সুন্দর আকর্ষণীয় করে তোলার ব্যাপারে। এ শহরকে নিজ বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো ভালোবাসতে হবে। তাহলেই একে পরিচ্ছন্ন, বসবাস উপযোগী সুন্দর নগরীতে পরিণত করা সম্ভব হবে। পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর ঢাকা গড়তে নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতাই সফলতার শক্তি।

সমস্যায় জর্জরিত ঢাকার অবস্থা খুব একটা বদলায়নি। ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। শহরের অধিকাংশ ফুটপাত দখল করে আছে দোকানপাট। এসব ফুটপাত সড়ক থেকে প্রায় এক ফুট উঁচু। শুধু তাই নয়, যখন তখন যে কেউই তাদের ইচ্ছামাফিক শহরের ফুটপাতে দোকান তুলছেন, পসরা সাজাচ্ছেন। এই দখল প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়নি। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই উচ্ছেদের জায়গাগুলো আবার দখল হয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো, হকারদের পুনর্বাসন ছাড়া ফুটপাত পথচারীবান্ধব

করা যাবে না। এই শহরে সারি সারি ভবন আর রাস্তাঘাটের বিস্তৃতি ঘটছে, কিছু কিছু এলাকার চাকচিক্য সৌন্দর্য বাড়ছে; তবে সেই তুলনায় বস্তির কোনো উন্নয়ন হয়নি। সুযোগ-সুবিধাও বাড়েনি। অথচ কর্তৃপক্ষ বস্তি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশনের খেলার মাঠগুলোর বেহাল অবস্থা খুব সহজেই চোখে পড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মাঠগুলোর নজরদারি করার কেউ নেই। খেলার মাঠে নেই খেলাধুলার পরিবেশ। নগরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বিনামূল্যের ওয়াইফাই সেবার আওতায় আনার ঘোষণা দিলেও এটি বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি কেউই।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ প্রথাগত দরপত্র আহ্বানের পরিবর্তে অনলাইনে ই-টেন্ডারের মাধমে করা হচ্ছে। এটা একটা পজিটিভ দিক সন্দেহ নেই। ফলে দরপত্র নিয়ে স্বজনপ্রীতির আশঙ্কা কমেছে অনেক। এজন্য কাজকর্মে অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, কয়েক হাজার অবৈধ বিল বোর্ড উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে, পুরো নগরজুড়ে প্রায় হাজার হাজার ময়লা-আবর্জনা ফেলার বিন বসেছে, সড়কে বসেছে আধুনিক এলইডি বাতি, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় নগরজুড়ে

অনেকগুলো গণশৌচাগার নির্মিত হয়েছে এবং এগুলো ঠিকঠাকমতো পরিচালিত হচ্ছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য কয়েকটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। পথঘাটে নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত জীবাণুমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে বিশেষ ধরনের গাড়ি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে। এই সাফল্য এবং কৃতিত্বের জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়।

দুই সিটি করপোরেশনের কাজকর্মে আরো গতি আনতে সব কাউন্সিলরকে নিয়ে একটি সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তা হলে বড় বড় সমস্যাকে আর পাহাড়-পর্বতের মতো মনে হবে না, সহজেই সমাধান করা যাবে। ঢাকা নগরীর বিদ্যমান সমস্যা, সংকট, অব্যবস্থা, অনিয়ম, অসুন্দর দূরীকরণের কাজগুলো রাতারাতি করা সম্ভব নয়। এজন্য সময় লাগবে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রই সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলোকে এক সুতোয় বাঁধার অর্থাৎ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন। সাধারণত উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে পারে না সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্মে নিয়োজিত এজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সব সময়েই লক্ষ করা গেছে। এটাকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ঢাকার দুই সিটি

করপোরেশনের কাজকর্মে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতার অবসান ঘটাতে দুই মেয়রই তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং দক্ষতার প্রয়োগ করবেন আশা করি।

এই নগরীকে স্বপ্নের মতো সুন্দর, বাসযোগ্য এবং নান্দনিক করতে প্রত্যেক নগরবাসীর নিজস্ব কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যে যার অবস্থান থেকে সেই দায়িত্বগুলো পালন করে গেলে আমাদের এই প্রিয় শহর কোনোভাবে পিছিয়ে থাকতে পারে না, বিশ্বের বাসের অযোগ্য শহরের কিংবা দুর্ভোগের শহরের তালিকায় ঠাঁই পেতে পারে না। দুঃস্বপ্নের বোঝা আর অনাগত বিপদের শঙ্কা বুকে বয়ে আমরা আমাদের প্রতিটি দিন পার করতে চাই না। অনেক সম্ভাবনা এবং সুন্দরের হাতছানি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এই প্রিয় রাজধানী ঢাকা শহর দুঃস্বপ্ন কিংবা দুর্ভোগের শহর হিসেবে বিবেচিত হোক আমরা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। আমরা মনেপ্রাণে চাই, ঢাকা শহর একটি চমৎকার বাসযোগ্য স্বস্তিকর জীবনের সুনিবিড় আন্তর্জাতিক মানের নান্দনিক শহর হিসেবে গড়ে উঠুক এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close