নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২১

বিশ্লেষণ

নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও বিপণন

বাংলাদেশে গত এক যুগে সবজি উৎপাদনে ঘটে গেছে এক নীরব বিপ্লব। বর্তমানে বছরে ১ কোটি ৭২ লাখ টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে সবজি উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে; এটা দেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য এক বিশাল অর্জন এবং গর্বের বিষয়। দেশে বর্তমানে ৬০ জাতের ২০০ ধরনের সবজি উৎপাদন হচ্ছে। সবজি উৎপাদন হচ্ছে বিস্তীর্ণ মাঠে, বসতবাড়ির আশপাশে, গ্রামীণ রাস্তার ধারে, ছাদবাগানে, হাওর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিচু এলাকায় ভাসমান বীজতলায়। এই সবজি উৎপাদনের সঙ্গে দেশের ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষি পরিবার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশ থেকে ৫০টিরও বেশি দেশে সবজি রপ্তানি হচ্ছে। সবজির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে দেশের অঞ্চলভিত্তিক কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠা ও রপ্তানি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। এ দাবি পূরণ করতে হলে কৃষকদের উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণপূর্বক বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদন করতে হবে। এতে কৃষক যেমন লাভবান হবেন, তেমনি দেশের মানুষ থাকবেন রোগমুক্ত, পরিবেশ থাকবে নিরাপদ এবং অর্জিত হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।

পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের অর্থায়নে সারা দেশে এ বছর ১১ উপজেলার ১১ ইউনিয়নে আইপিএম মডেল ইউনিয়ন স্থাপন করে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্যে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা ও শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ৭নং রামপুর ইউনিয়নে এই প্রকল্পের আওতায় এ বছর ২০টি দলের মাধ্যমে ৫০০ কৃষাণ-কৃষাণীর ১০০ একর জমিতে শীতকালীন নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কাজ চলছে পুরোদমে। সবজির মধ্যে রয়েছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, ব্রোকলি, শসা, করলা, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি। কৃষাণ-কৃষাণীরা সবজি পরিচর্যা, উত্তোলন ও বিক্রির কাজে বর্তমানে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। গত ৩১ ডিসেম্বর এই প্রকল্পভুক্ত কৃষাণ-কৃষাণীদের উৎপাদিত সবজি বিক্রির জন্য ত্রিশাল ইউএনও অফিস প্রাঙ্গণে উদ্বোধন করা হয় নিরাপদ সবজি বিক্রয় কর্নার। সবজি বিক্রয় কর্নারটি উদ্বোধন করেন ত্রিশাল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রবীণ রাজনীতিবিদ আলহাজ আবদুল মতিন সরকার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন প্রকল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ত্রিশাল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব আহমেদ।

উদ্বোধনের দিন ওই কর্নার থেকে চারজন কৃষক প্রায় ৬ হাজার টাকা মূল্যের বিষমুক্ত ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ ও কাঁচা টমেটো বিক্রি করেন। প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি করা হয় ৩০ টাকা দামে। টমেটো বিক্রি করা হয় প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরে এবং প্রতিটি বড় লাউ ৫০ টাকা এবং মাঝারি লাউ বিক্রি করা হয় ৪০ টাকা দামে। নিরাপদ সবজি ক্রয়ে উপজেলায় কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। ক্রেতাদের কথা, এখানে ন্যায্যমূল্যে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি পাওয়া গেলে কেন তারা বাজার থেকে বিষযুক্ত অনিরাপদ শাকসবজি কিনে পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলবেন তারা আরো বলেন, এই নিরাপদ সবজি কর্নারটি প্রতিদিন অফিস-ডেতে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকা উচিত, যাতে অফিস শেষে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ব্যাগভরে নিরাপদ সবজি কিনে বাসায় ফিরতে পারেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ত্রিশালের কাছ থেকে জানা যায়, উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ত্রিশাল পৌরসভায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে নিরাপদ সবজি বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ জেলা সদরে নিরাপদ সবজি কর্নার স্থাপনের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার দেশের ৬৪ জেলায় ‘কৃষকের বাজার’ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এসব বাজারে কোনো ধরনের খাজনা ছাড়াই সরাসরি কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবেন কৃষক। এমনকি কৃষকের বাড়ি থেকে বাজারে পণ্য নিয়ে আসতে পরিবহন সহায়তা দেবে সরকার। এটি করা সম্ভব হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন কৃষক। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রথমে অস্থায়ী ভিত্তিতে এসব বাজার চালু হবে। এরপর হালকা অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। পরে স্থায়ী রূপ পাবে এসব বাজার।

কৃষি বিপণন অধিপ্তরের কথা, সবজিসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনে ও বিপণনে কঠোর হচ্ছে সরকার। সরকার উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে বাজারে নিরাপদ কৃষিপণ্য বিক্রির বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে। সিন্ডিকেট ভেঙে পাইকারি ও খুচরা দামের মধ্যে পার্থক্য কমাতে পারলে বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে নিত্যপণ্যের দামও কমবে এবং কৃষকও লাভবান হবেন। এজন্য রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারিভাবে কৃষকের বাজার গড়ে তোলা দরকার। এতে লাভের অংশ কৃষকের পকেটে যাবে এবং উৎপাদনও বাড়বে। দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত ‘কৃষক বাজারে’ নিরাপদ সবজি বিক্রির জন্য আলাদা কর্নার স্থাপন করা যেতে পারে এবং নিরাপদ সবজি বিক্রেতাকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে থেকে নিরাপদ সবজির প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনে ক্রেতাকে তা দেখাতে হবে।

নিরাপদ সবজি উৎপাদনে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করায় পণ্য উৎপাদনে কৃষকের খরচ কম হওয়ায় লাভও হবে বেশি। আমাদের কথা শুধু উৎপাদন নয়, নিরাপদ সবজি ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থাও করতে হবে প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে কৃষিপণ্যের অনলাইন প্ল্যাটফরম ফুড ফর নেশনকে। নিরাপদ সবজি পরিবহনেও সরকারকে প্রণোদনা দিতে হবে। উৎপাদিত বিষমুক্ত নিরাপদ সবজির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য একশপ, কৃষান, আই ফার্মার, ডিজিটাল আড়তদার, আগোরা, স্বপ্ন প্রভৃতি অনলাইন কৃষিপণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে সঙ্গে প্রকল্পভুক্ত কৃষকের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া যেহেতু বিষমুক্ত নিরাপদ সবজির বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে, তাই উৎপাদিত সবজি রপ্তানির মাধ্যমে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকল্পে রপ্তানিকারক এবং উৎপাদনকারীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি কাজটিও করতে হবে প্রকল্পের পক্ষ থেকে। এ ব্যাপারে হরটেক্স ফাউন্ডেশন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিশেষ করে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রকল্প পরিচালকসহ অন্যরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। কারণ কৃষক যদি উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে লাভবান না হন, তাহলে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কখনো সফল হবে না।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close