আবদুর রউফ
পর্যালোচনা
উন্নয়নের সুফল সুষম বণ্টনেই নিহিত
প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন একটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। এর সমার্থক শব্দের মধ্যে রয়েছে বিবর্তন, বৃদ্ধি, প্রসরণ, বিস্তৃতি, প্রগতি, উত্তরণ ও বিকাশ ইত্যাদি। আবার এর বিপরীর্থক শব্দের মধ্য রয়েছে প্রত্যাবৃত্তি, পশ্চাৎগমন করা, প্রত্যাবর্তন করা। সাধারণভাবে উন্নয়ন বলতে বোঝায় কোনো অগ্রগতি বা অগ্রসরমান ব্যবস্থা বা কোনো কিছু বৃদ্ধি অথবা ব্যাপকতার ফলস্বরূপ প্রাপ্তি। এককথায় বলা যায়, উন্নয়ন হচ্ছে এক অবস্থা বা স্তর থেকে উন্নত বা কাক্সিক্ষত অবস্থায় উত্তরণ। তবে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মনে করেন, কোনো জাতি যদি কোনো সময়ের জন্য উন্নত জীবনযাপন করে, তবে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে না। উন্নয়নের গূঢ় অর্থ হলো ইতিবাচক উন্নত উন্নয়নের স্থায়িত্ব। যেমন কোনো দেশের সরকার যদি জনগণের মধ্যে পানির পাম্প বিতরণ করে, তাহলে যত দিন বিতরণ করবে, তত দিন তাদের পানির কোনো অভাব থাকবে না। যখন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে, তখন আবার তাদের দূর অবস্থা ফিরে আসবে। সুতরাং এ ধরনের বিতরণ বা সরবরাহ কোনোভাবেই উন্নয়নের সূচক নয়। এজন্য তিনি অবস্থার স্থায়িত্বকে মুখ্য হিসেবে গণ্য করেছেন; যা জনগণের জীবনে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জীবনে চলার প্রতিটি স্তরে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের একদম সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন না হয় তাহলে সেটাকে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলে গণ্য করা যাবে না।
‘উন্নয়ন’ শব্দটি এ সময়ের উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্য অন্যতম। তবে দেশের উন্নয়নের সুফল জনগণ কতটুকু ভোগ করছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। উন্নয়নের জন্য ব্যয় এবং উন্নয়ন থেকে প্রাপ্ত সুফল কতটুকু সর্বসাধারণ ভোগ করতে পারছে, তার যৌক্তিক দিক পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভালো করছে। আরো দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অকল্পনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রমাণ করে আমাদের দেশে এখন অনেক বড়লোক। যেমন গত কয়েক দিন আগে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ‘আকাশচুম্বী খরচ উন্নয়নে’। ৪১০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। তিন বছরের প্রকল্পের মেয়াদ এখন ১৪ বছর। পত্রিকার এই শিরোনাম প্রমাণ করে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। সরকার শুধু প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছে। তবে দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দক্ষ প্রশাসন ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কোনো দেশ দুর্নীতি, অশান্তি লালন করে টেকসই উন্নয়ন আশা করতে পারে না। দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তার ভিত্তি বা শিকড় যদি দৃঢ় না হয়, তবে একটা সময় তা ধসে পড়তে পারে। এ শঙ্কার কথা আবারও ব্যক্ত করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডি বলেছে, বৈষম্য দূরীকরণ, শান্তি ও ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের এখনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। তবে সবার জন্য শিক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রাথমিকভাবে সাফল্য এসেছে। এসডিজি অর্জনে সফল হতে হলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জবাবদিহি এবং সুশাসন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সত্যিই অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। তবে যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, তার প্রভাব নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরে পড়ছে না। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উন্নয়নের সুফল নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক মানুষ পাচ্ছে। তার চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশে ধনীদের উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধির চিত্র দেখে। দেশে যখন বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, তখন দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার আমানতদারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। অথচ গত সেপ্টেম্বর শেষে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৪৮৮। অর্থাৎ ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর, এই ছয় মাসে দেশে ব্যাংকে কোটি টাকা রাখার আমানতদারী সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তত্ত্বের বিবরণীতে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সবচেয়ে অতি ধনী বৃদ্ধির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ধনী বৃদ্ধির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীনকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। একদিকে যেমন দেশের ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্রতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু কোভিড-১৯ কালীন প্রথম ৬ মাসে দেশে শতাংশের দিক থেকে ধনী বৃদ্ধি পেয়েছে ১১.৪ শতাংশ। অন্যদিকে প্রায় ৪০ শতাংশ
মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় চলে গেছে। বর্তমান দেশে এ রকম ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রমাণ করে দেশের উন্নয়নের সুফল সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের পাচ্ছে না। নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক
মানুষ এই উন্নয়নের সুফলে নিজেদের কোটিপতি বানিয়ে নিচ্ছেন। অন্যদিকে গরিবরা আরো গরিবে পরিণত হচ্ছে। বর্তমান সরকার দেশের এই ক্রমবর্ধমান ধনী-গরিবের বৈষম্য চিত্রের প্রতি
অবহেলা করলে একসময় তা যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। করোনাকালীন দেশের অনেক মানুষ তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছে। অনেকেই বাসা ভাড়া না দিতে পেরে বাধ্য হয়ে রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে পাড়ি জমিয়েছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে ভ্রাম্যমাণ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই দেশে এ রকম ধনী-গরিবের বৈষম্য একটি অশনিসংকেত।
বারবার দাবি করা হচ্ছে, আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে অন্যান্য দেশের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেন, উন্নত দেশ বলতে, যেসব দেশ তার নাগরিকদের মুক্ত ও নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণ বা নিরাপত্তাসহ উপযুক্ত পরিবেশ, স্বাস্থ্যকর জীবন প্রদানে সক্ষম তাকে বোঝায়। সেক্ষেত্রে একটি দেশের উন্নয়নের মানদন্ডের সূচক শুধু অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি সেই দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নত হয়েছে তার ওপর। সেই সঙ্গে নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বাক স্বাধীনতা, ধর্ম ও লিঙ্গ নিরপেক্ষতা, পরিবেশের বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা, ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র ইত্যাদির ওপর। এ ছাড়া মুদ্রামানের স্থিতিশীলতা, শিল্প খাতের পাশাপাশি সেবা খাত ও অর্থনৈতিক বুনিয়াদ উন্নত দেশের অন্যতম মাপকাঠি।
নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতির পাশাপাশি দেশের জনগণের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, স্থায়ীভাবে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, খুন, গুম, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। যেদিন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিক নিজের দেশে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ মনে করবেন, যেদিন আমার দেশের মা-বোনেরা নিজেদের একদম নিরাপদ মনে করবে, নিজের বাকস্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা পাবেন, সেদিন নব্বই শতাংশ দেশ এমনি উন্নীত হবে। আমরা আশা করছি, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা, নারী নিরাপত্তা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সরকার ব্যাপকভাবে এবং সঠিক উপায়ে কাজ করবে। শুধু লোক দেখানো নয়, সব সমস্যার গোড়া থেকে সমস্যাগুলো নির্মূল করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবেই আমাদের বাংলাদেশ প্রকৃতভাবে উন্নত দেশে উন্নীত হতে পারবে। আমাদের প্রত্যাশা, রূপকল্প ২০২১-২০৪১ পরিকল্পনা সফল হোক। বাংলাদেশের তার নাম উন্নত দেশের তালিকায় অবস্থান নিশ্চিত করুক। এজন্য এখন থেকেই কঠোর প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার বাস্তবায় শুরু করা প্রয়োজন। তা না হলে উন্নত দেশ হওয়ার ‘রূপকল্প’ কল্পকথা হয়ে থাকবে।
তাই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সেই বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সমতাভিত্তিক অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে
হবে। তবে এই দেশের মানুষ উন্নয়নের সুফল সমভাবে ভোগ করতে পারবে।
শিক্ষার্থী : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
"