অলোক আচার্য

  ২১ জানুয়ারি, ২০২১

মুক্তমত

করোনার শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা

দেখতে দেখতে করোনা মহামারির মধ্য দিয়ে পুরো একটি বছর পার হয়ে গেল। ২০২১ সালকে সাদরে বরণ করেছি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে নতুন একটি বছর আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। পার করে আসা বছর অর্থাৎ ২০২০ সালও শুরু হয়েছিল নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু বছর শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেল। এক ভাইরাসের তা ব শুরু হলো। চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে একে একে গ্রাস করল পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ। সব মহাদেশেই করোনাভাইরাস বিস্তার করেছে। পৃথিবীর মানুষ দেখল, পৃথিবীর এক ভয়ংকর রূপ। যা বহু শত বছরের মধ্যে মানবজাতি দেখতে পায়নি। পৃথিবীজুড়ে যখন তীব্র প্রতিযোগিতা, অস্ত্রের ঝনঝনানি, তখন মানুষের সামনে মহাসংকট হয়ে এলো করোনাভাইরাস। কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে এই করোনাভাইরাস। যারা অনেক আশা নিয়ে নতুন বছরটি শুরু করেছিলেন, তাদের অনেকেই অকালে চলে গেলেন। এখনো প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের মৃত্যুও ঘটছে প্রতিদিন। বিজ্ঞানচর্চায় মানুষ বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। বিজ্ঞানের সাহায্যে মানবজাতি জয় করেছে বহু মরণব্যাধি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জয়যাত্রায় মানুষের গড় আয়ুও বৃদ্ধি পেয়েছে। একসময় কলেরা, বসন্ত, হাম মানুষের জন্য আতঙ্কের ছিল। আজ তা নেই। কারণ বিজ্ঞান সেসব রোগ জয় করেছে। করোনা সেই অগ্রসরমান মানবসভ্যতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। যে চ্যালেঞ্জ অন্যসব সংকটের মতো মানবজাতি বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশে দেশে। আশা করা যায়, করোনা খুব দ্রুতই পৃথিবী থেকে নির্মূল হবে। তবে অন্যসব ঘটনার মতো করোনাও আমাদের কিছু শিখিয়ে গেল। আমাদের ভবিষ্যতের কর্মপন্থায় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।

প্রতিটি ঘটনাই মানুষের জন্য শিক্ষা নেওয়ার থাকে। মানুষ ভবিষ্যৎ যাতে সমৃদ্ধ করতে পারে, সেজন্য অতীতের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। করোনা মহামারিও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। অতীতের মহামারি থেকেও আমরা লড়াই করা শিখেছি। করোনাকালীন মানুষ প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং এর ব্যবহারের বিশালতা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে। কারণ প্রথম দিকে করোনা প্রকোপ ঠেকাতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই লকডাউনের মতো পথে হেঁটেছিল। এর বিকল্পও ছিল না আমাদের হাতে। ওষুধ নেই, তাই বিকল্প ছিল স্বাস্থ্যবিধি। ঘরে থেকেই কাজকর্ম চালিয়ে যেতে হয়েছে। শিক্ষা থেকে শুরু করে অফিশিয়াল কার্যক্রমও করতে হয়েছে ঘরে বসেই। এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে প্রযুক্তি। কিন্তু সব দেশ তো প্রযুক্তির ব্যবহারে সমান সমর্থ নয়। ফলে যেসব দেশে এই সুবিধা অপ্রতুল তারা সমস্যায় পড়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা কিন্তু বোঝা গেছে। শিক্ষার কথাই যদি বলি, করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে শিক্ষা কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ সময় যাবৎ থমকে আছে। এই বিশাল ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। করোনার শুরু থেকেই যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তখন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে টেলিভিশন, অনলাইনে এ কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের সবাইকে এ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়নি। নানাবিধ সমস্যার কারণেই সেটি সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তিগত সুবিধা, ইন্টারনেট গতি, সচেতনতা এ রকম আরো কিছু। আমাদের যে ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগত সুবিধাকে আরো প্রসারিত করার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সবার ঘরে পৌঁছে দিতে হবে, তা অনুধাবন করতে পেরেছি। অনলাইনে ক্লাস করার মতো ফোন থাকতে হবে।

করোনায় লকডাউনের সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ছিল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরুর পরও মানুষের উপস্থিতি ছিল সীমিত। এ সময় ই-কমার্স বা অনলাইনে ব্যবসা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। গত বছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় করোনাকালীন অনলাইনে বিক্রি বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। এ খাতের ১ হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠানে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তারাও ই-কমার্সে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করছেন। লাখ লাখ নারী উদ্যোক্তা ফেসবুকে তাদের পণ্য বিক্রি করছেন। এতে একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ই-কমার্স মানুষের আস্থা অর্জন করছে। করোনাকালে ই-কমার্সের যে দ্রুত অগ্রগতি ঘটেছে, সেই ধারা বজায় থাকলে আগামী কয়েক বছরে এই খাত কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। চাকরির বাজারে চাপ কমবে এবং আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করবে। প্রায় সব রকম পণ্যই এখন অনলাইনে মিলছে। ক্রেতা তার পছন্দমতো পণ্য অর্ডার দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘরে বসেই সেই পণ্য হাতে পাচ্ছেন। এতে তার সময় বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে এ সময়ে করোনা থেকেও নিজেকে সুরক্ষা দিতে পারছেন। তাছাড়া মানুষ এখন ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মাঝে পছন্দের পণ্যটি কিনতে হলে তাকে আলাদা সময় বের করতে হয়। অনেক দোকান ঘুরতে হয়। এখন সেটা না করে যেকোনো সময়ে পছন্দের পণ্যটি অর্ডার করলেই হলো। এই স্বনির্ভরতা অর্জনের জনপ্রিয় একটি মাধ্যম এখন কেবল সামনের দিকেই অগ্রসর হবে।

এই ভাইরাস একসময় প্রাণের মতোই স্তব্ধ করে দিয়েছিল বিশে^র অর্থনীতি, রাজনীতি, খেলাধুলা, শিল্পচর্চা সবকিছু। করোনাকালীন বন্ধ থাকা প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক ধরনের বিকল্প চিন্তাশক্তি কাজ করেছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বা নিজেকে কোনো ভাইরাস থেকে দূরে রেখে, কীভাবে জীবন সামনে এগিয়ে নেওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রেই সেসব পন্থা সামনে এসেছে। কারণ মানুষ পুরোপুরি বসে থাকতে পারে না। মানুষ কাজ করতে চায়। মানুষের জীবন-জীবিকা বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। করোনাকালীন অর্থনৈতিকভাবে একটি পেশার ওপর যারা নির্ভরশীল তারা আরো বেশি দুর্দশায় কাটিয়েছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা। দেশের কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের কথা বলি। অথবা নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক। এখনো তাদের জীবন কাটছে দুর্বিষহ। অনেকে আজ অন্য পেশায়। করোনার মতো এমন মহাসংকট সামনে না এলে এই দুরবস্থার সৃষ্টি হতো না। করোনা মহামারি পুরো পৃথিবীকেই একটি শিক্ষা দিয়ে গেছে। তা হলো একতার শিক্ষা। যে শিক্ষা পৃথিবী প্রায় ভুলতে বসেছিল। অস্ত্র আর ক্ষমতার নামে প্রায়ই অশান্ত হয়ে উঠছিল পৃথিবী। আচমকা করোনাভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সবাইকে একতাবদ্ধ থাকতেই হবে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় মানুষ বহু সংকট থেকে উত্তরণ পেয়েছে। করোনার শুরু থেকেই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছিলেন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের। অবশেষে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। বিজ্ঞানের শুভ ব্যবহার মানবজাতিকে এই গ্রহে টিকে থাকতে সাহায্য করবে আর ধ্বংসাত্মক ব্যবহার মানবজাতির জন্য বিনাশক হিসেবে কাজ করবে।

এখন নতুন বছর। নতুন করে সবকিছু শুরু হয়েছে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সব। শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পর্যটন স্পট, হোটেল-মোটেল সবকিছু চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হয়তো দ্রুতই খুলবে। জীবন চলবে আগের নিয়মে। তবে আমাদের মাঝে যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি করোনা মহামারি থেকে, তা কাজে লাগাতে হবে। যেমন স্বাস্থ্যবিধি। আমাদের দেশে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আওতায় আনা যে কী কঠিন কাজ, সেটা আমরা বুঝেছি। আজও মাস্ক পরা আমরা সবাই আয়ত্ত করতে পারিনি। করোনার সময়েও মাস্কবিহীন চলেছি অনেকে। বারবার হাত পরিষ্কার করার কথা বলা হলেও মেনেছি কজন? অথচ হাত জীবাণুমুক্ত করা একটি নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি; যা শিশুকাল থেকেই আয়ত্ত করা উচিত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, হাত ধোয়ার মতো সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিগুলো আমাদের মেনে চলা উচিত এবং আমাদের সন্তানদের অভ্যাস করানো উচিত। করোনা মহামারি চলে গেলেও এই অভ্যাস আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য উত্তম। আমাদের তা অনুধাবন করতে হবে। পৃথিবীকে মানুষই পারে বদলে দিতে। মানুষের হাতেই গড়ে উঠবে করোনামুক্ত নতুন পৃথিবী।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close