মো. জামিন আহমেদ

  ২১ জানুয়ারি, ২০২১

বিশ্লেষণ

অপ্রতিরোধ্য পুতিন ও আগামী বিশ্ব

এটা সবারই জানা যে, ট্রাম্প আমলে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল অনেকটা লেজেগোবরে। তবে বাইডেনের পূর্ব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা থাকায় মার্কিনিরা এবার আশার আলো দেখতে পারে। বাইডেনের জয়ে আমেরিকানরা আনন্দে ভাসলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কপালে ঠিকই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বিশেষ করে চিরবৈরী শত্রু রাশিয়ার জন্য এটা অশনিসংকেত। ট্রাম্পের দুর্বলতার সুযোগে বিশ্বে পুতিন যেভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিলেন, তবে কি তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল? সুতরাং ট্রাম্প-পরবর্তী সময়ে বিশ্বে তথা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মেরূকরণ নিয়ে নতুন করে হিসাব মেলানোর সময় এসেছে।

বাইডেন ও পুতিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ইতিহাস তুলনা করলে দেখা যায়, হোয়াইট হাউস অধিপতি ক্রেমলিন অধিপতির চেয়ে এগিয়ে। জো বাইডেনের ১৯৭০ সালে সিনেটর হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন। অন্যদিকে পুতিন ১৯৮৫ সালে রুশ গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেওয়া এক কর্মকর্তা মাত্র। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত পতন-পরবর্তী সময়ে রাশিয়ায় গণতন্ত্র চালু হলে পুতিন ১৯৯৯ সালে বরিস ইয়েৎসলিন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান। আবার জো বাইডেন ওবামা সরকারের দুই মেয়াদে (২০০৯-২০১৭ সাল) ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। দুই নেতার পূর্ব রাজনৈতিক অতীত বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অচিরেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আধিপত্যের লড়াইয়ের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বিশ্ববাসী।

পুতিনের উত্থান অনেকটাই নাটকীয়। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণকালে তখনো অধিকাংশ রুশ জনগণের কাছে অচেনা ছিলেন তিনি! অনেকটা আচমকা ইয়েৎসলিন পদত্যাগ করলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ সুগম হয় পুতিনের। সম্ভবত এ সময় ক্ষমতায় বসেই নিজের গদি আমৃত্যু ধরে রাখতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সেরে ফেলেছিলেন দূরদর্শী পুতিন। পুতিন ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে হলে জনগণের আস্থা অর্জনের বিকল্প নেই। আর তাই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ধুয়ো তুলে চেচনিয়ার রাজধানী গজনিতে আক্রমণ চালান। তখনই রুশ জনগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, একমাত্র পুতিনই পারে তাদের সুরক্ষা দিতে। ২০০৮ সালে জর্জিয়া এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে আবারও বিপুল জনপ্রিয়তা নিজের ঝুলিতে যুক্ত করেন পুতিন। নিজের গদি পোক্ত হওয়ার পরপরই সোভিয়েত ইউনিয়নের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার ও রাশিয়াকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের মাঠের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন।

পুতিনের সাম্প্রতিক তৎপরতায় আলোকপাতে এটা পরিষ্কার যে, তিনি রাশিয়াকে বিশ্বে সুপার পাওয়ারে অদ্বিতীয় করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ কিংবা এশিয়া কোথায় নেই পুতিন! দুই দশক ধরে বিশ্বমঞ্চ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরিয়ায় রুশ সেনা পাঠান পুতিন। ধারণা করা হয়, ইরানের অনুরোধে সাড়া দিয়ে পুতিন এত বড় চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছিলেন। মূলত এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিতে আগে থেকেই ইরান আতঙ্কে ছিল। ইরান তড়িঘড়ি করে কাশেম সুলাইমানিকে (পরে ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত) পাঠিয়ে পুতিনকে রাজি করাতে সক্ষম হন। তখন মধ্যপ্রাচ্যে রুশদের উপস্থিতিকে ইরানের পাশাপাশি স্বাগত জানিয়েছিল ইরাক ও লেবাননের হিজবুল্লাহও। সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান ও নৌঘাঁটি তৈরি করলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান হুমকির মুখে পড়ে। তবে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের গদি ঠিক রাখা নয়, সিরিয়ায় অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ বজায় রাখাই ছিল পুতিনের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি পশ্চিমাদের রাশিয়ার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করার বিষয়টি তো আছেই। এ অঞ্চলে আরব বসন্তের নামে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রে কিছুটা হলেও তখন জল ঢেলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন পুতিন। আসাদের শাসন বজায় রাখলেন সেই সঙ্গে সিরিয়ার মাটিতে পশ্চিমা সমর্থিত বিরোধীদের কোণঠাসা করতে সক্ষম হলেন। এরমধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পুতিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এক মেরুর রাজনীতির প্রতি অনেকটা চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিলেন। এদিকে আরব বসন্তে প্রায় সব একনায়ক সরকারের পতন হলেও আসাদের গদি এখনো ঠিকই আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তখন একটি মজার বিষয় ঘটেছিল, সেটি হলো ওই সময় সিরিয়ায় রুশ বাহিনীর সঙ্গে আসাদের সেনাবাহিনীর একটি প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেখা যায়, প্যারেডে রুশ বাহিনীর সঙ্গে আসাদের সেনাবাহিনী পা মেলাতে পারছিল না! আসাদের সেনাবাহিনী যখন বিরোধীদের হাতে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন পুতিনের আগমন পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিল। বলাই বাহুল্য, পুতিন এগিয়ে না এলে হাফিজ আল আসাদের ছেলে আসাদের ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো। সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পুতিন আসাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিশ্বকে বুঝিয়ে দিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে থেকে আপাতত বিদায় নিচ্ছেন না তিনি।

আমরা জানি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপের অবস্থান কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক অভিজ্ঞতা আছে ইউরোপের। উল্লেখ্য, সেসময় বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের রাজধানীর দিকে তাক করে মোতায়েন ছিল রুশ পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র। সংগত কারণেই রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত থাকায় ইউরোপের দ্বন্দ্ব নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট ইয়ানকোভিচের পতনের এক সপ্তাহে সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেন পুতিন। এরপরের মাসেই অর্থাৎ মার্চে ক্রিমিয়া দখল করেন। সেই সঙ্গে রুশপন্থি বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে থাকেন পুতিন। ফলে ইউক্রেনে সরকার বনাম রুশপন্থি বিদ্রোহীদের মধ্যকার লড়াই দীর্ঘায়িত হয়। পরে ২০১৮ সালে ডিসেম্বরে আর্জেটিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে পুতিন বলেন, ইউক্রেনে পাশ্চাত্যপন্থি রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। এদিকে ইউরোপের আরেক প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও বিরোধ হয় পুতিনের। বিরোধের সূত্রপাত্র হয় ২০১৮ সালের মার্চে রুশ গোয়েন্দা সের্গেই স্কিপালের ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে। তখন তেরেসা মের সরকার রাশিয়াকে সরাসরি দায়ী করে উপরন্তু ২৩ জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেন। যুক্তরাজ্য রাশিয়াকে কতটুকু হুমকিতে দেখে, ব্রিটিশ সেনাপ্রধান মার্ক কার্লটনের একটি মন্তব্যে তা স্পষ্ট হয়। তিনি ওই বছরের নভেম্বরে বলেন, রাশিয়া আইএসের চেয়ে বড় হুমকি! এ অঞ্চলের আরেক উদীয়মান শক্তিশালী দেশ তুরস্কের সঙ্গে ২০২০ সালের আগস্ট মাসে গ্রিসের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দ্বন্দ্ব চলাকালীন রাশিয়া তুরস্ককে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ দিতে সম্মত হয়। অথচ ২০১৮ সালে সিরিয়া যুদ্ধে রুশ বিমান তুরস্ক ভূপাতিত করলেও পুতিন কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষায় মূলত এ কাজ করেন। তুরস্ক ও সাইপ্রাসের বিরোধ বহু পুরোনো। এখানেও বিরোধ মেটাতে এগিয়ে আসেন পুতিন। এর ফলে সাইপ্রাসের সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্ক স্থাপিত হয় রাশিয়ার। তার প্রমাণ মেলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট আনাস্তাসিয়াদাসের রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভের হাতে গ্র্যান্ড ক্রস উপহার তুলে দেওয়ার মাধ্যমে। তুরস্ক ও সাইপ্রাস তথা এই দুদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে মূলত শ্যাম এবং কূল দুই-ই রাখলেন পুতিন। এদিকে আবার সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশ আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরে। উল্লেখ্য, আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি আছে। পুতিন এখানেও দুপক্ষে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সমাঝোতা করে দেন।

পুতিন সম্প্রতি এশিয়ায়ও প্রভাব বিস্তারে উঠে পড়ে লেগেছেন। বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চশমা দিয়ে এশিয়াকে দেখে। এবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক মিত্র ও এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি ভারতের কাছে এস-৪০০ বিক্রির চুক্তি করে ফেললেন। আনন্দ বাজারের খবর অনুযায়ী, ভারত ২০২৫ সালের মধ্যেই এস-৪০০ পেতে যাচ্ছে। এ চুক্তিটি এমন সময় হলো যখন ট্রাম্পের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে এবং বাইডেন নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি হালকাভাবে নেয়নি এবং দেরি না করে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে। দেখা যাচ্ছে, পুতিন এখানেও দাবার গুঁটি সুনিপুণভাবেই বসালেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পুতিনের কার্যক্রমে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার জারদের প্রভাব স্পষ্ট। পরাক্রমশালী রুশ জারদের যে Warm Water Policy, সেটাই তিনি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরে সেটা তিনি বেশ সফলভাবেই করছেন। তবে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় পর পুতিনের জন্য কতটুকু চ্যালেঞ্জ তৈরি করল, সেটা সময়ই বলে দেবে। আবার আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকার ২০১৬ সালের নির্বাচনে পুতিন যা করেছেন, এরপর তার পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই।

লেখক : শিক্ষার্থী

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিজয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close