রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

একুশ শতকের বিশ্ব ভয়ংকর সময়ের সাক্ষী

পৃথিবীর সবচেয়ে সুসংগঠিত রাষ্ট্রে আইনের শাসন যে কতটা ঠুনকো, কত বিভক্ত সেখানকার রাজনীতি এবং দেশটা যে গৃহযুদ্ধের কতটা কিনারে, ক্যাপিটল হিল-কা- তা দেখিয়ে দিল। টুইন টাওয়ারের ঘটনা যেমন আমেরিকাকে বদলে দিয়েছিল, বদলে দিয়েছিল দুনিয়ার স্থিতিশীলতাকে, ক্যাপিটল হিলের নৈরাজ্য তেমন আরেকটা ঘটনা, যার আগের আর পরের পরিস্থিতি আর এক থাকবে না। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র যেমন তার ভেতরে টুইন টাওয়ারের ঘটনা ঠেকাতে পারেনি, তেমনি বিশ্বের সেরা গণতন্ত্রের সেরা পীঠস্থান ক্যাপিটল হিল এক বেলার জন্য বেদখল হওয়াও ঠেকাতে পারেনি আমেরিকার গণতন্ত্র, আমেরিকার প্রশাসন। অনেকে বলছেন, এটা ঘটতে দেওয়া হয়েছে। ঘটতে দেওয়া হয়েছে যাতে ট্রাম্পকে অভিশংসন করা যায়, যাতে তাকে আর এক দিনের জন্যও প্রেসিডেন্ট থাকতে না দেওয়া হয়, যাতে চিরতরে ট্রাম্পের রাজনীতির কবর দেওয়া যায়, যাতে ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বলে ঘোষিত হন এবং যাতে গত নভেম্বরের নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ ট্রাম্প করে যাচ্ছেন, তাকে আরো হাস্যকর ও ঘৃণিত বলে দেখানো সম্ভব হয়। ঠিক এভাবেই হিটলার দলবল নিয়ে জার্মান রাইখস্ট্যাগ আক্রমণ করেছিলেন, ঠিক এভাবেই কিন্তু ফরাসি বিপ্লবীরা নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীর ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ বিপ্লব না প্রতিবিপ্লব, তা বলার জন্য আরো সময় দরকার। আপাতত বলা যায়, মাফিয়া ক্ষমতা রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার কাছে পরাজিত হলো।

তবে যারা বিশ্বাস করে ট্রাম্পকে বেআইনিভাবে কারচুপি করে হারানো হয়েছে, তারা যেকোনো কিছু করতে পারে। ক্যাপিটল হিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক আবাসিক এলাকা। সেখানেই কংগ্রেস ভবন মার্কিন গণতন্ত্রের সৌধ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ৬ জানুয়ারি আক্রান্ত হয়েছে সেটাই। যখন বিজয়ী ঘোষিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্ষমতায়নের বৈধতা দেওয়া হচ্ছিল, তখন ট্রাম্পপন্থি জনতা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেখানে হামলে পড়ে। কংগ্রেসম্যানরা পালাতে বাধ্য হন। লিংকন কথিত মার্কিন গণতন্ত্রের আত্মহত্যার ব্যর্থ মহড়া দুনিয়া দেখল। আর সেটা ঘটল সেদিন, ঠিক এক বছর আগে যেদিন আমেরিকা ইরাকে ইরানি রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান হাজি কাশেম সোলাইমানিকে ড্রোন হামলা করে হত্যা করেছিল। এভাবে পার্লামেন্ট ভবনে বিদ্রোহী জনতার হামলার

ঘটনা যদি ভেনিজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে ঘটত কিংবা ঘটত ইরানে বা তুরস্কে, তাহলে মার্কিন প্রশাসন তাদের অভিনন্দন জানাত। অনেক মার্কিনবিরোধী মানুষ এখন তেমন করেই

সন্তোষ জানাচ্ছেন। কিন্তু ঘটনাটা আরো গভীরে। এর ইঙ্গিতই কি অনেকে দিয়ে যাচ্ছিল না? হলিউডি সিনেমা ডার্ক নাইটে একবার, তারপর সাম্প্রতিক জোকার সিনেমায় কি এমন দৃশ্য আমরা দেখিনি!

উন্মত্ত জনতা সব শৃঙ্খলা ভেঙে দিচ্ছে, জনতা এলিটদের আক্রমণ করছে। উদ্দেশ্যহীন তা-বে আমেরিকা ভেসে যাচ্ছে। এর মধ্যে নাচছে তাদের নেতা, উন্মাদ কিংবা ভাঁড়ের ছদ্মবেশে থাকা এক নৈরাজ্যবাদী। সেই চরিত্র, ডার্ক নাইট বলছে, ‘সামান্য নৈরাজ্য আরম্ভ করো, কায়েমি ব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দাও, দেখবে সবকিছু ভেঙে পড়বে। আমি নৈরাজ্যের প্রতিনিধি, জানো তো, উন্মত্ততা হলো মাধ্যাকর্ষের মতো, এর জন্য শুধু দরকার সামান্য একটা ধাক্কা। যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি আব্রাহাম লিংকন ক্যাপিটল হিলকে দুবার রক্ষণশীলদের সামরিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন। রক্ষণশীলদের পতাকা সেখানে আর ওড়েনি। কিন্তু ক্যাপিটল হিলে মার্কিন কংগ্রেস ভবনে এবার সেই পতাকা উড়ল। বিক্ষোভকারীরা নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে, তা করতে পারল কয়েক ঘণ্টার জন্য। আব্রাহাম লিংকনের কথাটাই সত্যের কাছাকাছি বলে দেখা গেল। ১৮৩৮ সালে তিনি বলেছিলেন, বিপদ যদি এসে পড়ে, তবে তা আসবে আমাদের ভেতর থেকে। এটা বাইরে থেকে আসতে পারবে না। যদি ধ্বংসই আমাদের নিয়তি হয়, আমরাই হব তার রচয়িতা ও সম্পন্নকারী। মুক্ত মানুষের দেশ হিসেবে আমরা হয় চিরকাল থাকব, নয়তো আত্মহত্যা করব। ক্যাপিটল হিলে জনতার হামলার ঘটনায় পুলিশের গুলিতে নিহত নারীটি মার্কিন গণতন্ত্রের সেই পূর্বকথিত আত্মহত্যা চেষ্টার প্রতীক হয়ে থাকবেন। ২০২০ সালের এ সময়ে এসে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রতি কেবল রোমাঞ্চের জন্য মনোযোগী নই। অভূতপূর্ব অনুভূতি আসলে উত্তেজনা নয়, বরং ভয়।

২০১৬ সালে ট্রাম্প ছিলেন রিপাবলিকানদের মধ্যকার সবচেয়ে উদ্ভট। এরপর থেকে আমরা সাংবিধানিক সম্পদ বহ্ন্যুৎসব হতে দেখি। এ বছরের জুন মাসে ওয়াশিংটন ডিসির রাস্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কি না, এ প্রশ্নে আমরা তার চূড়ান্ত রূপ দেখি। আমেরিকার সামরিক বাহিনীর নেতারা রাজনৈতিক বশ্যতা স্বীকার করবে কি না, এ উদ্বেগ ছিল। তবে স্বস্তি আসে এটা জানার পর যে, তারা র‌্যাংক ও ফাইলের চেয়ে ট্রাম্পের প্রতি কম গুরুত্ব দেবে। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকা-ের জেরে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ যখন সর্বোচ্চ সহিংস রূপ নিয়েছিল, সে সময় সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে শেষ পর্যন্ত বাদ সাধেন পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আমেরিকার ভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা রয়েছে। রাজ্যের প্রতিটি স্তরের মেশিন সাধারণত দলীয় রাজনৈতিক সংকীর্ণতায় প্রভাবান্বিত। আমরা হয়তো দেখব, ভোটের বুথগুলো সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা পূর্ণ। যারা ট্রাম্পের আদেশ মানছে। ইতোমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ ও কার্টার সেন্টার, যারা সারা বিশ্বেও ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোট ঐতিহাসিক সংকটের সম্মুখীন। তবে ট্রাম্পেও ভয়ানক শোর বিপরীতে উদার চরিত্রও দেখতে হবে। এতে করে মার্কিন রাজনীতির বিভাজন আরো সহিংসতার দিকেই যেতে পারে। অনেক সুশীল ট্রাম্প সমর্থক এখন বাইডেন শিবিরে, তথা ডেমোক্র্যাট শিবিরে ভিড়ছে। কিন্তু হতাশ ও ক্ষুব্ধ ট্রাম্পপন্থিরা আরো মরিয়া হচ্ছেন। কংগ্রেস ও সিনেটে রিপাবলিকানরা আরো দুর্বল হয়ে যাবে।

ফলে বাইডেন এমন একচেটিয়া ক্ষমতা উপভোগ করবেন, যা ট্রাম্পও করতে পারেননি। এর অর্থ আমেরিকার রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। তা যদি হয়, তাহলে মেরূকরণ আরো বাড়বে। নিচুতলায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে বিগত নির্বাচন। এবারে তিনি ভোট পেয়েছিলেন আগেরবারের চেয়ে বেশি। এরা হারিয়ে যাবে না। ট্রাম্প ভীরু ও লাজুক মানুষদের জাগিয়ে দিয়েছেন। সুপ্ত ঘৃণাবাদীরা এখন আরো সাহসী। ট্রাম্প চলে গেলেও এরা থেকে যাবে। অন্যদিকে ঐতিহাসিকভাবে ডেমোক্র্যাটরা যুদ্ধবাজ বলে পরিচিত। তাদের আমলেই আমেরিকা বেশি আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি বেছে নেয়। উপরন্তু, নতুন প্রশাসনে একজনও প্রগতিশীল মন্ত্রী নেই। ট্রাম্প চলে গেলেও জলে কুমির ডাঙায় বাঘ অবস্থা থেকে না আমেরিকা, না পৃথিবী, কেউ ?মুক্তি পাবে। ট্রাম্প আমেরিকার রাজনীতি ও সমাজকে ঘোলা পানিতে টেনে নামিয়েছিলেন, ক্যাপিটল হিলের ঘটনায় তিনি দেশটাকে বিপজ্জনক দরিয়ায় ঠেলে দিলেন। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল লোকজন একে বিদ্রোহ এবং অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা বলে বর্ণনা করছেন। এই বর্ণনা যথোপযুক্ত। কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে, তার ভঙ্গুরতা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। নির্বাহী

ক্ষমতার ব্যবহার ঘটিয়ে তিনি আবার এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করবেন না বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে অভ্যুত্থানের

চেষ্টা তিনি করবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়। তার এবং তার সমর্থকদের আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস ভবনের নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গ্রীষ্মকালে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বলে গড়ে ওঠা নাগরিক আন্দোলন মোকাবিলা নির্বিচার শক্তি প্রয়োগে দ্বিধা দেখা যায়নি, কিন্তু একটি সমাবেশের কথা জানার পরও কোনো রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার ছিল না, সেটা অবশ্যই প্রশ্নের উদ্রেক করে। ভবিষ্যতে ট্রাম্প কী করবেন এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন সময় উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার। যদি জো বাইডেন ও ডেমোক্র্যাটরা জয়লাভ করে, আমাদের প্রথম যেটা করতে হবে সেটা হলো নিশ্চিন্ত থাকা। প্রাত্যহিক জীবনের ঝামেলা এড়িয়ে নিরাপদ থাকা। বাইডেনের প্রতিশ্রুতি স্মরণ করুন, আমেরিকাকে আবার স্বাভাবিক করুন। বারাক ওবামার আট বছরের স্বাভাবিক সময়ের পর ট্রাম্পের বিজয় দেখেছিলাম আমরা। এখন ২০২০ সালের নির্বাচনের পরের প্রশ্ন হবে : আমেরিকার রাজনীতি কি পরিবর্তন হবে? যদি না হয়। একুশ শতকের বিশ্ব হয়তো আবার ভয়ংকর সময়ের সাক্ষী হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close