সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

  ১৬ জানুয়ারি, ২০২১

পর্যালোচনা

নতুন সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে নাকি অন্য কোথাও

আমাদের ইতিহাসের আইয়ুব-মোনায়েম জমানার একজন জাঁদরেল আমলা তার সারগেদদের সবক দিতেন ‘ধরেই নেবে যে লোকটা ক্রিমিনাল, এরপর সে প্রমাণ করুক যে সে তা নয়।’ একালে করোনাভাইরাসেরও দেখছি বিশ্বব্যাপী ওই একই ভাব; সে ধরেই নিয়েছে যে মানুষটাকে সে মারবে, এরপর মানুষটা যদি পারে তবে সে বাঁচুক। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে করোনা আর কিছু রাখবে না। পারলে বাঁচো নইলে অল্প পরেই মৃত্যু তোমার অবধারিত। জীবনের সঙ্গে অবশ্য জীবিকাও থাকে, জড়াজড়ি করেই থাকতে চায়। অনেকের জন্যই জীবনের চেয়েও জীবিকা বড় হয়ে দেখা দেয়। জানের জন্যই মাল বটে, তবে মাল না থাকলে জান বাঁচে কী করে?

তা জীবন ও জীবিকার এই ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবারকার নির্বাচন বেশ ভালোভাবেই আসবে বলে মনে করা হয়েছিল। করোনাকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, করোনা উড়ে যায়নি, উল্টো জুড়েই বসেছে। অমন সমৃদ্ধ দেশ, বিশ্বের সেরা, সেখানেই দেখা গেল মানুষ মরছে সবচেয়ে বেশি। তাই ধারণা করা হয়েছিল করোনায় অব্যবস্থাপনা নির্বাচনে বড় একটা ইস্যু হয়ে দেখা দেবে। সেভাবে তাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। ডেমোক্র্যাটরা ঠিকই টানাটানি করেছে; তবে যেভাবে সে কাজ করবে মনে হয়েছিল, সেভাবে করল না। ভূমিধসের কোনো আওয়াজ পাওয়া যায়নি। রিপাবলিকানরা যে খুব কম ভোট পেয়েছে তা নয়; ডেমোক্র্যাটদের ৭ কোটি ৯২ লাখের বিপরীতে রিপাবলিকানদের ভোট ৭ কোটি ২২ লাখ; সত্তর লাখের ব্যবধানকে খুব বড় বলা যাবে কি? জীবিকা কম গুরুত্ব পায়নি জীবনের তুলনায়।

খাঁটি রিপাবলিকানরা অবশ্য ঠিক করেই রেখেছিল যা-ই ঘটুক তারা তাদের নেতা ট্রাম্প সাহেবের পিছু ছাড়বে না। তিনি মিথ্যা কথা বলেন? হাজার হাজার মিথ্যা এরই মধ্যে বলে ফেলেছেন? তার নৈতিক চরিত্রে নানা রকমের স্খলন আছে? তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি-কটূক্তি করে থাকেন? হ্যাঁ, সবই ঠিক আছে। কিন্তু তিনি একজন বাপের বেটা। আমেরিকাকে তিনি সব দেশের শীর্ষে রাখবেন। দেশের পবিত্র ভূমিকে কালো, বাদামি, হলুদ এসব রঙের মানুষদের দখলবাজি থেকে মুক্ত করবেন। মুসলমানদের তাবে রাখবেন। তিনি চলে গেলে মহাসর্বনাশ। ছবিতে দেখলাম এক বৃদ্ধ কান্নাকাটি করেছেন, ট্রাম্প থাকবেন না এমন ভয়ে। হ্যাঁ, করোনা মানুষ মারছে এটা ঠিক; কিন্তু সত্য তো চীনাদের আগ্রাসনও আর চীনাদের ধমক দিতে পারেন ওই রকম মানুষ মার্কিন মুলুকে তো ওই একজনই অবশিষ্ট আছেন। তার পেছনে দাঁড়াতে হবে। কোটি কোটি মানুষ দাঁড়িয়েছেও। অধিকাংশেরই ভয় ট্রাম্প চলে গেলে তাদের জীবিকা বিপন্ন হবে আর জীবিকাই যদি ঠিক না থাকে, তাহলে জীবন বাঁচবে কি করে? করোনাকালে ট্রাম্প যে সবকিছু খোলা রাখার পক্ষে ছিলেন, সে তো তার নিজের স্বার্থে নয়, আমেরিকানদের জীবিকা যাতে বিপন্ন না হয়, সেই স্বার্থেই। গড়পড়তা আমেরিকানরা অসংশোধনীয় রূপে বস্তুবাদী; কমিউনিস্টদের তারা ঘৃণা করে, কিন্তু বাস্তববাদিতার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের ছাড়িয়ে যায়। তাদের বাস্তববাদিতা আসলে স্থূল বস্তুবাদিতা। সেখানে অন্য কারো জন্য বিবেচনা নেই, এমনকি অত্যন্ত আপনজনের জন্যও নয়। বেচারাদের দোষ নেই। গড়পড়তা আমেরিকানদের ওভাবেই শেখানো-পড়ানো হয়েছে। তারা নিজের কাজের জায়গাটা চেনে, পার্ল হারবার কোথায়, তা জেনে তাদের কারবার নেই। তাদের কাছে উন্নতি মানে নিজের উন্নতি, নিরাপত্তার অর্থ নিজের জীবিকার নিরাপত্তা। তাদের চিন্তায় ‘আমি ভালো তো জগৎ ভালো।’ জলবায়ু পরিবর্তন বা বায়ুদূষণ তাদের কাছে দূরের ব্যাপার। করোনাভাইরাসও বিবেচ্য নয়, যতক্ষণ না নিজে তারা শয্যাশায়ী হচ্ছে। ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন? ভালোই করেছেন। টাকা বেঁচেছে। তিনি বিষাক্ত কার্বন নির্গমন কমাতে সম্মত নন? ঠিক কাজই করেছেন, ফুয়েল পোড়ানো ছাড়া উৎপাদন বৃদ্ধির উপায় কী? গড়পড়তা আমেরিকানের ভাব-বিবেচনা এই রকমের।

ট্রাম্প সাহেব এই গড়পড়তা আমেরিকানকে ঠিক ঠিক চেনেন; তিনি নিজেও তাদেরই একজন এবং এদের কাছেই তার আবেদন। তিনি জানেন যতই যা ঘটুক এরা তার সঙ্গ ছাড়বে না। যেজন্য তিনি ভাবছেন এবারে হারলে কী হবে, আগামীতে আবার দাঁড়াব এবং তখন আমার সমর্থন কমবে না, বরং বাড়বে। কারণ গড়পড়তা আমেরিকান দেখতে পাবে জো বাইডেন কেবল ব্যক্তির নয়, সমষ্টির কথাও ভাবতে চাইছেন, ভাবাবার জন্য বামপন্থিরা তো বটেই, উদারনীতিকরাও তার ওপর চাপ দিচ্ছে। ফলে ‘উন্নতি’ কমবে। হারানো স্বর্গ ফিরে আসবে, এমন আশা নেই। কিন্তু স্বপ্ন তো থাকবে। ভর দুপুরেও স্বপ্নরা জীবিত থাকে।

তবে গড়পড়তা আমেরিকানই যে একমাত্র আমেরিকান নয়, ট্রাম্পের পরাজয়ে সেটাও দেখা গেল। সাধারণ আমেরিকানরাও আছে, তাদের সংখ্যা বেশিমাত্রায় না হলেও অধিক বৈকি এবং তারা ট্রাম্পমার্কা উন্নয়ন সমর্থন করে না। বলা হচ্ছে এবং দেখাও গেল আমেরিকার নির্বাচনে এবারে যত বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছে তেমনটি আগে কখনো ঘটেনি। পাছে ভোট না দিতে পারে তাই ডাকযোগে আগেভাগেই ভোট দিয়েছে অনেক মানুষ। ভোটের দিন প্রবল শীত ও বিপজ্জনক করোনাকে উপেক্ষা করে অতিপ্রত্যুষেই যেভাবে লাইন ধরেছে, সে দৃশ্যও অভূতপূর্ব। এর কারণ কী? কারণ এই বোধ যে, তার ওই ভোটেই ঠিক হবে আমেরিকায় কারা কর্তৃত্ব করবে; খাঁটি রিপাবলিকানরা, নাকি তাদের বিরোধীরা? কার জয় হবে? গড়পড়তা আমেরিকানের, নাকি সাধারণ আমেরিকানের? দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। গড়পড়তা আমেরিকান হচ্ছে গুণ থেকে দোষ বাদ দিয়ে ১০০ জনকে একত্র করলে যে ৮০ জন দাঁড়াবে (ধরা যাক) তাদেরকে ১০০ দিয়ে ভাগ করলে যে ফলটা পাওয়া যাবে সেটি আর সাধারণ আমেরিকান হলো ১০০ জনকে ১০০ জন ধরেই ভাগ করলে যে ফলটা আসবে সেটা।

বলা যাবে যে, নির্বাচনে জো বাইডেন জিতেননি, ট্রাম্প হেরেছেন মাত্র। কথাটা মিথ্যা নয়। জো বাইডেনের প্রান্তিক বিজয়ে আমেরিকায় বৈদেশিক নীতিতে যে মস্ত বড় রদবদল ঘটবে, তা মোটেই নয়, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও যে পরিবর্তনটা ঘটবে বলে আশা করা যায়, তাও মোটেই বৈপ্লবিক কিছু হবে না; নতুন প্রেসিডেন্টকেও আপস করেই চলতে হবে। তবু ভাষায়, ভঙ্গিতে ও সামগ্রিক আবহাওয়াতে যে পরিবর্তনটা ঘটবে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাইবা কম কীসে? সর্বোপরি ট্রাম্প জিতলে মানুষের জীবনে সংকট যে রকমের বৃদ্ধি পাবে বলে শঙ্কা ছিল তার হাত থেকে তো রক্ষা পাওয়া যাবে। মন্দের ভালো জিনিসটা ঘোরতর মন্দের চেয়ে তো ভালোই হওয়ার কথা। মনোভাবটা এ রকমের।

আমেরিকার নির্বাচন সারা বিশ্ব দেখেছে। কারণ এর ভেতরে আগামী দিনে বিশ্বব্যবস্থা কোনদিকে কতটা ঝুঁকবে, তার একটা ইশারা পাওয়ার কথা। বাংলাদেশেরও গৃহবন্দি বিস্তর মানুষ ভোটগণনার ওপর চোখ রেখেছে। এটা অনেকটা ইচ্ছাপূরণও বটে। দুধের সাধ মেটানো ঘোল পানে। এ দেশের মানুষও নিজেদের জাতীয় নির্বাচনকে উৎসবের মতোই উপভোগ করতে চায়; ভোটে কে এগিয়ে যাচ্ছে, কে পিছিয়ে পড়ছে, কার জয়ের সম্ভাবনা, কার সম্ভাবনা পরাজয়ের, সেটা রাত জেগে এবং দিনেও দেখাটা একটা ঔৎসুক্য ও আনন্দের বিষয় ছিল; সে সুখ এখন অতীতের স্মৃতি হয়ে গেছে এবং সে আর ফিরে আসবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ। অন্য দেশের উৎসব দেখে তাই শখ মেটানোর কাজ চলেছে।

মূল জিনিসটা হচ্ছে ক্ষমতা। আর এখনকার ‘মুক্ত’ বিশ্বে ক্ষমতা সরাসরি যুক্ত বাণিজ্যের সঙ্গে। বাণিজ্য-ব্যাপারে ক্ষমতা নিয়ে পুঁজিবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্বটা আরো হিংস্র আকার ধারণ করবে। ধরা যাক চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা। আগামীতে এটা যে কেমন ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে, তার লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। চীনের নেতৃত্বে এরই মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তিটি সম্পাদিত করেছে। চীন এখন ধেয়ে আসবে, আমেরিকা ও ইউরোপকে ধাক্কা দেবে এবং বাণিজ্যে আধিপত্য নিয়ে লড়াইটা তীব্র হবে। গত শতাব্দীতে পুঁজিবাদীরা দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে ছেড়েছে, তার ভুক্তভোগী হয়েছে সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষ আর এই যে হিংস্র বাণিজ্যযুদ্ধ এতেও ক্ষতিটা হবে ওই মেহনতীদেরই। পুঁজিবাদীদের ভেতরে ঝগড়া-ফ্যাসাদের কারণে করোনাভাইরাসের আক্রমণের চাইতেও বড় রকমের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। সেটা কোন রূপ ধরে আসবে আমরা জানি না; তবে কোন কোন জায়গা থেকে আসবে, সেটা বোঝা যায়। আসবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণ থেকে; আসবে বৈষম্য থেকে, আসবে বেকারত্ব, অনাহার, মুনাফালিপ্সা, ভোগবাদিতা, হিংস্রতা ইত্যাদির বৃদ্ধির কারণে; আসবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান থেকে। ওই শক্তি আবার চাইবে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে, বর্ণ ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়ে, মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে দমন করতে। পুঁজিবাদীরা ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচনী প্রথাটাকে চালু রাখতে চাইবে, মানুষ ভাববে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই পরিবর্তন আসবে। একেবারেই যে আসবে না, তাও হয়তো নয়, কিন্তু সে পরিবর্তন উপর কাঠামোর অল্প এলাকারই। লোক বদলাবে, কিন্তু ব্যবস্থা বদলাবে না। অনেক ক্ষেত্রে লোকও বদলাবে না। আর রাষ্ট্রক্ষমতায় যেই আসুক স্বার্থ দেখবে সে ধনীদের; মেহনতীদের নয়। ক্ষমতা ঘোরাঘুরি করতে থাকবে টাকাওয়ালাদের বৃত্তের মধ্যেই। বদলটা হবে মুখোশের, মুখশ্রীটা একই।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close