পর্যালোচনা
অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন
মোহম্মদ শাহিন
গোটা বিশ্বে ক্রমেই আজ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লু ইকোনমি। ব্লু ইকোনমি বা নীল বিপ্লব হচ্ছে সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। অর্থাৎ সমুদ্রের অবস্থিত বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যা যুক্ত হয় তা ব্লু-ইকোনমির অন্তর্ভুক্ত। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ সমুদ্রবক্ষে সঞ্চিত এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির নতুন দিগন্তরেখার সূচনা করেছে।
বাংলাদেশ সমুদ্রসীমাবেষ্টিত হওয়ায় সুনীল অর্থনীতির (ব্লু ইকোনমি) অপার সম্ভবনা ও ভূরাজনীতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অঞ্চলের কর্তৃত্ব পায়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৪৫ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের সার্বভৌম প্রতিষ্ঠারও অধিকার পায়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৮৮ শতাংশ নীল সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ সমুদ্র বিজয়ে যে আঞ্চলিক মালিকানা পেয়েছে, সেখানে তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্যসম্পদ আহরণ, বন্দরে সমুদ্রসীমা সম্প্রসারণ ও পর্যটন এ চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হবে।
গভীর সমুদ্রে রয়েছে মৎস্য আহরণের বিপুল সম্ভাবনা। বঙ্গোপসাগরের অতলে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। এ ছাড়াও শামুক, ঝিনুক, শ্যালকিস, কাঁকড়া, অক্টোপাস ও হাঙ্গরসহ রয়েছে বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। এগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থকরী সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত। সঠিকভাবে আহরণ করে এগুলো রফতানি করতে পারলে অর্থনীতির চাকা খুলে যাবে। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’-এর তথ্যমতে, সমুদ্র থেকে শুধু মাছ ধরে বিদেশে রফতানি করেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। গভীর সমুদ্রের টুনা মাছ সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়। সুস্বাদু ও দামি এই মাছটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের হোটেলগুলোতে আমদানি করা হয়ে থাকে। এই মাছ সঠিকভাবে আহরণ করতে পারলে নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন দেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। সমুদ্রের তলদেশে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আগাছা রয়েছে; এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরি করা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান ইসপিরুলিনা। প্রাণিসম্পদ ছাড়াও ১৩টি জায়গায় মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিশ্বে এ দুটি ধাতুর চাহিদা কত মূল্যবান, তা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া সিমেন্টশিল্পের প্রচুর পরিমাণে ক্লের সন্ধান পাওয়া গেছে বঙ্গোপসাগরের ৩০-৮০ মিটার গভীরে। অগভীর সমুদ্র থেকে এসব ক্লে উত্তোলন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের সিমেন্টশিল্পেও আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
বিভিন্ন তথ্য মতে, বিশ্বে ৭৩০ কোটির বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিন জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেক্ষেত্র থেকে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (উঈঈও) হিসাব মতে, বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ আসে সমুদ্রের মাছ আহরণ, সামুদ্রিক খাদ্য ও বাণিজ্যিক সমুদ্র পরিবহন হতে। দেশের প্রায় তিন কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রনির্ভর সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে যদি দেশীয় অর্থনীতিতে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়, তাহলে ভিশন-২০৪১ পূর্ণ করা সহজ হবে। ফলে আমরা অতিদ্রুতই উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছে যাব।
বাংলাদেশের এত বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনাময় সমুদ্রসম্পদের যথাযথভাবে আহরণ ও ব্যবহার করতে পারছি না বলে আজ আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই, কীভাবে একটি দারিদ্র্য রাষ্ট্র থেকে সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে গেছে নরওয়ে। আজ ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার আয় করছে; যা ২০২৫ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে এত বিপুল পরিমাণ সমুদ্রসীমাবেষ্টিত অঞ্চল থাকা সত্ত্বেও আমরা এই অপার সম্ভাবনাময় সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করতে পারছি না। বর্তমানে বাংলাদেশের ট্রলারগুলো উপকূল থেকে ৩৫-৪০ নটিক্যাল মাইলের বেশি মাছ আহরণ করতে পারে না অথচ আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০০ নটিক্যাল মাইল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়, কিন্তু বাংলাদেশ সেখানে ৯০ হাজার টন মাছ ধরতে পারে মাত্র।
সময় এসেছে সমুদ্রনির্ভর এই বিশাল শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে সরকারকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের। ব্লু-ইকোনমি নিয়ে গবেষণা, কার্যকর পদক্ষেপ ও উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন দ্রুত বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। যদিও সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছে। সমঝোতা চুক্তি করতে চীন প্রস্তাব দিয়েছে, জাপানও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়াও হাতে নেওয়া হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি জরিপ কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা উচিত, যেখান থেকে খুব সহজেই সমুদ্রসম্পদ আহরণের তথ্য মিলবে। নতুন করে ফের ব্লু ইকোনমি নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করছে সরকার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক, সমুদ্রের তলদেশে প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ ব্যবহার করতে হলে যে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তি দরকার; এখনো সেই পরিমাণ জনশক্তি ও প্রযুক্তি আমাদের দেশে নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকে এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। প্রয়োজনে বিদেশি দক্ষ সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে একযোগে কাজ করা যেতে পারে। সমুদ্রনির্ভর এ অপার সম্ভাবনাময় সম্পদের যথাযথ আহরণ ও সঠিক ব্যবহারে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নতুন বিভাগ চালু করে গবেষণাগার তৈরি করা যেতে পারে। এ সময় দক্ষ জনবল গঠনে সরকারকে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে সমুদ্রসম্পদের কাজে লাগাতে পারলে একদিকে যেমন দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়ে বেকারত্ব নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে; অপরদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে দেশ। সব মিলিয়ে আশা করা যায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও ভিশন-২০৪১ অর্জনে সম্ভানার দুয়ার খুলে দেবে ব্লু-ইকোনমি।
লেখক : শিক্ষার্থী
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"