reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

গ্রামীণ টেকসই উন্নয়নে পর্যটন

সাধন সরকার

সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটনের রূপ ও প্রকৃতিতে এসেছে অভাবিত পরিবর্তন। বিশ^ব্যাপী পর্যটনকে বলা হয় ‘অদৃশ্য রফতানি পণ্য’। পর্যটন এমন একটি শিল্প যেখানে বিনিয়োগ, চাকরি ও আয়ের কোনো সীমা নেই। অর্থনীতির অন্যতম বিকশিতমান খাত পর্যটন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি বাংলাদেশের গ্রামীণ পর্যায়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পর্যটনশিল্পের বিকাশে প্রত্যাশিত ও কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে না। বাংলাদেশের পাশর্^বর্তী অনেক দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশ পর্যটনকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হিসেবে গ্রহণ করেছে। মেক্সিকো ও ইন্দোনেশিয়ার মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৬০ ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, তিউনিসিয়া প্রভৃতি দেশ পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নে সমর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম পর্যটনবান্ধব দেশ হওয়া সত্ত্বেও কেন সম্ভাবনাময় এ খাতটিকে এগিয়ে নিতে পারছে না। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পর্যটনের উৎকর্ষ সাধনের পর্যাপ্ত সুযোগ যেমন রয়েছে; তেমনি রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এ ছাড়া এ দেশের আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান, নৈসর্গিক স্থান সর্বোপরি পরিবেশ সবই পর্যটনশিল্পের অনুকূলে। বিস্তীর্ণ পাহাড়-পর্বত, বিশে^র অন্যতম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, বিশে^র দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, চা বাগান, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের অপরূপ লেক, সোনারগাঁও, কাপ্তাই, কুয়াকাটা, ময়নামতি, পাহাড়পুর, বিভিন্ন নদ-নদী, সৈকত, চর, জলপ্রপাত, জলাধার, দ্বীপসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, প্রতœতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্থানসমূহ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ।

বিশ^ অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) গত বছর প্রকাশিত ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৯’ অনুযায়ী ১৪০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। অথচ এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ পর্যটনের বিকাশ ও টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলে বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সবচেয়ে বড় বিষয় নিরাপত্তা ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়ন। পর্যটন খাতকে কাগজে-কলমে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে ততটা এর প্রতিফলন ঘটেনি। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হিসাবমতে, সারা দেশে আটশর বেশি পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ২৪-২৬টি পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বেশি পছন্দ। প্রতি বছর কক্সবাজারেই দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করে থাকে।

যদিও করোনাকালে পর্যটনশিল্পে ধস নেমেছে। পুরো বিশ্বে পর্যটনশিল্পে মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখা যাচ্ছে! ধারণা করা যাচ্ছে, করোনাকাল শেষ হতে হতেই পর্যটনশিল্পে গতি ফিরে আসবে। ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর’ এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান মাত্র দেড় শতাংশ। প্রতি বছর বাংলাদেশ ভ্রমণে আসে মাত্র ৯ লাখ পর্যটক আর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যায় ১৫ লাখ! সাধারণ মানুষের মধ্যে পর্যটন শিক্ষা ও দেশি পর্যটনকেন্দ্র সম্পর্কে না জানার কারণে দেশি পর্যটকরা বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশি পর্যটনশিল্পের প্রচার ও প্রসারের অভাবে দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ২০১০ সালে সরকার ‘জাতীয় পর্যটন নীতিমালা’তে পরিবেশ, প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে টেকসই পর্যটন উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বললেও বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না! পর্যটনবান্ধব অন্যান্য দেশ এ শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। তাই স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূর করে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমের’ প্রতি গুরুত্বারোপ করার বিকল্প নেই। সরকার ২০১৬ সালকে ‘পর্যটনবর্ষ’ ঘোষণা করে এর কার্যক্রম ২০১৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেও দেশি পর্যটন স্থানের প্রচার ও দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা তেমন বাড়েনি বললেই চলে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয় পর্যটকের হার বাড়াতে নিরাপত্তা, দুর্বল যোগাযোগ ও অবকাঠামো, দক্ষ গাইডের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি গ্রামীণ পর্যটন স্থান ও দর্শনীয় স্থাপনাগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, সরকারি ও বেসরকারি যুগোপযুগী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আবার রোহিঙ্গা বসতি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটনকেন্দ্রের পরিবেশ ও সৌন্দর্য নষ্ট করছে। রোহিঙ্গা সমস্যা যত দ্রুত সমাধান হবে, ততই দেশের পর্যটনশিল্পের জন্য মঙ্গল বয়ে আসবে। প্রকৃতি-পরিবেশ বজায় রেখে পরিকল্পিত ও টেকসই পর্যটন উন্নয়নের প্রতি জোর দিতে হবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা যাতে কোনো প্রকার বৈষম্য ও হয়রানির শিকার না হয়; সেজন্য সংশ্লিষ্ট নীতিমালা ও নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। দেশের জানা-অজানা অসংখ্য আকর্ষণীয় গ্রামীণ স্থানগুলোকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। জেলাভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্রের বিকাশ, প্রচার ও প্রসারে বিশেষ নজর দিতে হবে। এতে করে বিভিন্ন জেলার স্থানীয় পর্যটকরা কাছের এসব বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্রে যেতে পারবেন। এ ছাড়া পর্যটন খাতে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। উন্নত দেশের মতো পর্যটনশিল্পে পৃথক আইন তৈরি করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জনে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সার্বিক অর্থনীতির বিকাশসহ টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। বাংলাদেশে পর্যটন আকর্ষণের অভাব নেই। অভাব আছে শুধু পরিকল্পিত উদ্যোগ, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার। পর্যটনশিল্পে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করতে পারলে এবং উপযুক্ত পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close