reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বিশ্লেষণ

শেখ হাসিনা নেতৃত্বে এলেন যেভাবে

বাদল চৌধুরী

ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে। তাই সত্যের আরেক নাম ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক নাম টুঙ্গিপাড়া। এককালের অখ্যাত, বর্তমানে খ্যাতির শীর্ষে যে জনপদ, তার নাম আজ আর কারো কাছে অজানা নয়। বরং ছোট-বড় সব মানুষের কাছে বিশেষ পরিচিত এই জনপদ টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদীর তীরঘেঁষে ছবির মতো সবুজের সমারোহ আর ছায়াঘেরা লতাপাতায় সাজানো একটি গ্রাম।

এখানেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার জন্মকালের নিভৃত সেই গ্রামের ছবি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এখানেই আছেন চিরনিদ্রায়। তার সমাধিকে কেন্দ্র করে টুঙ্গিপাড়ার সেকালের অতিপরিচিত দৃশ্য একালে দ্রুত পাল্টে গেছে, বদলে গেছে। এখন এ গ্রাম পরিণত হয়েছে বাঙালির তীর্থভূমিতে।

এই ভূখন্ড ধারণ করে আছে এ দেশের মহানায়ক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান স্থপতি, বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ধন ক্ষণজন্মা এক মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ক্ষণজন্মা পুরুষের ঔরসেই জন্মগ্রহণ করেন আরেক মহীয়সী নারী। যে নারীর অস্থিমজ্জায়, রক্তে-মাংসে মিলেমিশে আছে গর্বিত পিতার আদর্শ, গুণ, ধৈর্য, স্থিতি, অপরিসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল এবং যার জীবনে সমন্বয়ে ঘটছে গরিব-দুঃখীর মর্মব্যথা; তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনা। যিনি কঠোর সংগ্রাম আর আন্দোলন করে বিভিন্ন সময়ের স্বৈরাচারকে হটিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন করে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায়ে নির্বাচিত হয়ে চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পিতার উত্তরাধিকারে প্রধানমন্ত্রী হননি কিংবা কারো করুণায়ও নয়। নিজ যোগ্যতা দিয়ে দিনে দিনে তিনি যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন; সেই অর্জনের মূল্যায়নের আজ জনগণনন্দিত জননেত্রী। তিনি মনে করেন, দলের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়া বড় কিছু নয়। কারণ তিনি জনগণের সেবা করতে চান, হতে চান দেশের আজীবন সেবক। তার এই সাহসী উচ্চারণ আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। তার জন্মও সেকালের ফরিদপুরের অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ায় ইংরেজি ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর মাতা রতœগর্ভা ফজিলাতুন নেছা খাতুন। শেখ হাসিনার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল টুঙ্গিপাড়াতেই। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে ঢাকায় আসেন, তখন শেখ হাসিনা আজিমপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এখানেই তার স্কুলের গন্ডি শেষ হয়।

শেখ হাসিনা ছাত্রী হিসেবে বৃত্তি পাওয়ার মতো না হলেও মেধাবী ছিলেন। একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করলেই রেজাল্ট ভালো হতো। কিন্তু তাদের বাসায় সর্বক্ষণ চলত রাজনীতিচর্চা। ঠিকমতো পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার মতো কোনো পরিবেশই ছিল না। এরই মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তার ভাই-বোনদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হতো। বাবা বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন কারাগারে। স্বাভাবিকভাবেই কিছু না কিছু রাজনীতির দিকে কিশোরী শেখ হাসিনার মন ছুটে যেতই লেখাপড়ার পাশাপাশি। বঙ্গবন্ধু একটা কথা তাদের সব সময়ই বলতেন, ‘রাজনীতি হলো দেশের মানুষের জন্য কিছু করা, নিজে কী হবে, সেটা বড় কথা নয়। রাজনীতির অর্থ দেশসেবা করা। এখানে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান বড় কথা নয়। নীতি ও আদর্শই হলো মূল্যবান।’

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু যদি ইচ্ছে করতেন তবে ইয়াহিয়ার অধীনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। আর পিন্ডি থেকে পিআইএর বিমানে এসে ঢাকায় পা দিতে পারতেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যতম সদস্য শেখ হাসিনাও। ফলে এই মাটির মানুষগুলোকে হয়তো দেখতেন তিনিও করুণার চোখে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি আপস করেননি। আমৃত্যু চেয়েছেন এ দেশের মানুষের অধিকার রক্ষা করতে। ছোটবেলা থেকেই গ্রামের দরিদ্র মানুষের প্রতি ছিল তার গভীর মমত্ববোধ। পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ শেখ হাসিনা সেসময় বলতেন, আমি বড় হলে এই দরিদ্র মানুষের দুঃখ ঘোচাব। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে খেতে বসতেন, কথা প্রসঙ্গে ছয় দফার কথা উঠলে দুই হাতের ছয়টি আঙুল তুলে পাঁচটি নামিয়ে ফেলে একটি উঁচিয়ে রাখতেনÑ এটা তাদের প্রায় সবারই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, শুধু মুখে উচ্চারণ করা বারণ ছিল। অবশ্য এই ইশারাই যথেষ্ট যে, আমরা কী চাই।

শেখ হাসিনার জন্মই রাজনৈতিক পরিবেশ এবং পরিবারে। পিতার রাজনৈতিক জীবনের ছায়া তার জীবনে খুব গাঢ়ভাবে পড়েছিল সেই কিশোরী বয়সেই, তার প্রমাণ মেলে ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের সময়। তিনি তখন আজিমপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রী। ১০ সেপ্টেম্বর স্কুলে ধর্মঘট করে ছাত্রী মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সময় শাসকগোষ্ঠীর পুলিশ মিছিলটিকে আক্রমণ করে এবং হলের কাছে পুলিশের লাঠিচার্জের মুখে সঙ্গীদের নিয়ে রোকেয়া হলে অবস্থান নেন শেখ হাসিনা। কিশোরী বয়সে এই প্রথম মিছিলে সরাসরি অংশগ্রহণ তার। সেই মিছিল করার আনন্দ, নেতৃত্ব এবং অভিজ্ঞতা তাকে দুর্বারভাবে টানতে থাকে রাজনীতি অঙ্গন। কিশোরী বয়সের সেই চেতনা, অনুভূতি ক্রমশ দূরন্ত করে তুলতে থাকে তাকে, তার রক্তকে।

১৯৬৬ সালে ইডেন গার্লস কলেজের ছাত্রী থাকাকালে ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং কলেজ ছাত্রী সংসদের সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এরপর ক্রমশ তিনি আরো বেশি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ওই বছরই শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৬ দফা জাতির খেদমতে পেশ করেন। ১৯৬৭ সালে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অনার্সে ভর্তি হন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে তিনি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখাকে সংগঠিত করেন পিতার মতো যোগ্য নেতৃত্বে।

‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে বটতলার ছাত্রসভা ও মিছিলে ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ায় বাবাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল তার। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের পর তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়। তখন ক্যান্টনমেন্টে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য একমাত্র বেগম মুজিব, হাসিনা ও ড. এম ওয়াজেদের অনুমতি ছিল। প্রহরীদের সম্মুখেই সাক্ষাৎকার হতো তাদের। শেখ মুজিবকে বাইরের খবরাখবর ও রাজনৈতিক অবস্থা শেখ হাসিনা ওই সময় খুবই কৌশলে শোনাতেন। যা কি না প্রহরীরা বিন্দুমাত্র বুঝতেই পারত না। ছাত্রনেতাদের বার্তা দেওয়া-নেওয়ার কাজটিও শেখ হাসিনা খুব কৌশলের সঙ্গেই করতেন। শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ শেখ হাসিনা নিয়ে এসে আবার ছাত্রনেতাদের জানাতেন।

এর একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, হাসিনার স্বামী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার উদ্ধৃতিতে। ‘সেদিন আব্দুর রউফ ও তোফায়েল আহমদের যৌথ স্বাক্ষরিত চিঠিটি নিয়ে হাসিনা ও আমি ইকবাল হল থেকে সোজা ক্যান্টনমেন্টে শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই। শেখ সাহেব তখন তার সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অনেককে আটকে রাখা সামরিক মেসের তার কক্ষের বারান্দায় বসেছিলেন। তার থেকে কিছু দূরে এক সামরিক কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। আমাদের দেখেই শেখ সাহেব উচ্চৈঃস্বরে কর্তব্যরত সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার মেয়ে ও মেয়ে জামাই এসেছে আমাকে কিছু বলার জন্য। আমি গেটে গিয়ে তাদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।’ উক্ত সামরিক কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলার আগেই শেখ সাহেব দ্রুত মেসের গেটের কাছে চলে আসেন। তখন হাসিনা ও আমি গেটের একটু ভেতরে প্রবেশ করি। শেখ সাহেব ‘মা হাসু’ বলে হাসিনাকে জড়িয়ে ধরলে ওই সুযোগে সে ছাত্রনেতাদের চিঠিটি তার গেঞ্জির নিচে গুঁজে দেয়। এ পরিস্থিতি দেখে ওই সামরিক কর্মকর্তাও গেটের দিকে আসতে থাকেন। কিন্তু সেই সামরিক কর্মকর্তা গেটে পৌঁছার আগেই শেখ সাহেবকে ছাত্রনেতাদের বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত করি। তখন শেখ সাহেব আমাদের পরদিন একইভাবে ছাত্রলীগের আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী ও তোফায়েল আহমদকে ওই সামরিক মেসের গেটের কাছে আনতে বলেন। এরপর পারিবারিক বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বলে আমরা সেখান থেকে চলে আসি।’

শুধু তাই নয়, মেধা, প্রজ্ঞা এবং বাবার মতো উদার হৃদয়ের অধিকারী তিনি। অন্যকে প্রভাবিত করার গুণও তার চমৎকার। তাই অতিদ্রুত তিনি মানুষের সঙ্গে অনায়াসেই মিশে যেতেন স্বাভাবিক আচরণের জন্য। এভাবে তিনি খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্র-নেতৃত্বে নিজের স্থান করে নিলেন। সে নেতৃত্বের ধারবাহিকতার ফসল-যোগ্য নেতৃত্ব, দলের সভানেত্রী এবং সর্বোপরি জননেত্রী। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদীয় দলের নেতা হন এবং প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব পালন করেন। ঠিক তেমনি ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদীয় দলে নেতা হন। বর্তমানে সফলতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব পালন করছেন।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close