reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মুক্তমত

অসুস্থ স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসা প্রয়োজন

নিগার সুলতানা সুপ্তি

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশ যখন করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর একের পর এক মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। এই দুর্নীতি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ভুয়া করোনাভাইরাস নেগেটিভ রিপোর্ট, লাইসেন্স ছাড়াই হাসপাতালে করোনাভাইরাস চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া এবং সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা ‘আয়’ করা, যাদের কোনো অনুমতিই নেই, তাদের দিয়ে করোনা টেস্টের নামে ‘বুথ’ তৈরি করে নমুনা সংগ্রহ করা, সবকিছু স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম, অদক্ষতা আর দুর্নীতির চিত্র সামনে নিয়ে এসেছে। কিছুতেই যেন স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

যেন নামটাই মুখে আনা বারণ। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে কথা উঠলেই কিছু নাম উচ্চারিত হয়। কিন্তু সব নামই ডান ও বামের। আসল নামটি উচ্চারিত হয় না। যেন সমীহই করে খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। যেন ভাসুরের নাম মুখে নিতে মানা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভেতর মিঠুর প্রভাব এতটাই প্রবল। যে কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মিঠুকে তলব করলে তিনি সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুদকের চিঠির জবাবে পাল্টা নসিহত করেন। অথচ আলোচিত এই ‘মিঠু’ নিছক ‘ইউনিসেফ’র মিনা কার্টুনের মিঠু নন। তিনি মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডন। যার ইশারায় স্বাস্থ্য খাত ওলটপালট হয়ে যায়। মন্ত্রী-সচিব বদল হয়। মিঠু শারীরিকভাবে দেশে অনুপস্থিত। অথচ এখনো দেশের স্বাস্থ্য খাত তারই নিয়ন্ত্রণে। এই করোনাকালেও তার সিন্ডিকেট বেশি সক্রিয়। মানহীন মাস্ক সরবরাহ কেলেঙ্কারিতে মিঠুর বিষয়েও দুদক অনুসন্ধান করছে বটে। কিন্তু তার পুরোনো অনুসন্ধানগুলো ধামাচাপা দিয়ে। আফজাল-কান্ড মিঠু প্রযোজিত চিত্রনাট্য মাত্র। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, মাস্ক-পিপিই কান্ড। একই সুতোয় গাঁথা সাহেদ-ডা. সাবরিনা-আরিফ কান্ডও। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতের আরেক নাম উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোটিপতি গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে বাদল এখন বহুল আলোচিত চরিত্র। পেশায় একজন গাড়িচালক হয়েও তিনি শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। নিয়োগ, পদোন্নতি, জাল নোটের কারবারসহ বহু অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য খাতে কথিত ‘গডফাদাররা’ এতই শক্তিশালী যে, এদের অনেকে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের এই দুর্বলতার কারণ কী? সাধারণ চোখে মনে হবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে কম বাজেটই এর কারণ। আর প্রশ্ন করলে এই খাত নিয়ে যারা ভাবেন তারা আরো অনেক কারণ দেখান। কিন্তু সবার কাছ থেকেই একটি কথা ‘কমন’ শোনা যায়, আর তা হলো দুর্নীতি। এবার স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। তার পরও আশা জাগছে না। কারণ এই বরাদ্দ যদি দুর্নীতির পেটে চলে যায়, তাহলে বাজেট বাড়িয়ে কী লাভ? বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন বরাদ্দের শতকরা ৮০ ভাগই দুর্নীতির পেটে চলে যায়। গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে। তার মধ্যে বেশি দুর্নীতি হয় : কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহ খাতে। সাদা চোখে দেখা দুর্নীতির বাইরে একটি অভিনব দুর্নীতির কথাও তখন বলে দুদক। আর তা হলো, দুর্নীতি করার জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা। এমন যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা পরিচালনার লোক নেই। ওইসব যন্ত্রপাতি কখনোই ব্যবহার করা হয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ১৮৬ গুণ বেশি দাম দেখানো হয়েছে। এক সেট পর্দার দাম দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। ১৭৫ কোটি টাকার নি¤œমানের যন্ত্রপাতি কেনা হয় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য। রংপুর মেডিকেল কলেজে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও চার কোটি টাকার সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা কখনোই ব্যবহার করা হয়নি। দুর্নীতিই আগে প্রতিরোধ করতে হবে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ হয়েছে, তা যদি স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরিকল্পনা করে ব্যবহার করা হতো তাহলে স্বাস্থ্য খাতের চেহারা অন্যরকম হতো। এর সঙ্গে জনবল বাড়াতে হবে। জোর দিতে হবে স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং গবেষণায়। আর সেবাটা হতে হবে অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিমূলক। সব হাসপাতালে স্থানীয়দের নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠনের নিয়ম থাকলেও তা হয় না। আর যেখানে আছে তা কার্যকর নয়। ডা. এহতেশামুল হক বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবী, মন্ত্রী, এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের যার যার এলাকার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাহলে তারা নিজেরাই পরিস্থিতি দেখবেন এবং উন্নয়নে মনোযোগী হবেন।’ শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যক্তির পদত্যাগ বা অপসারণ কোনো কাজেই আসবে না। পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে একেবারে ঢেলে সাজাতে হবে। ছোট থেকে বড় প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গায় থেকে সৎ ও আন্তরিকভাবে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হবে। তাছাড়া কোনোভাবেই জনগণকে হাসপাতালমুখী করা যাবে না। বরং ভেঙে পড়বে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সাধারণ নিষ্পাপ মানুষকে জীবন দিয়ে যার মাশুল দিতে হবে। যা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। একজন মহাপরিচালক পদত্যাগ করলেই স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, তেমনটা নয়। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ছড়িয়েছে তৃণমূল পর্যন্ত, যার পিছনে রয়েছে বড় বড় রাঘববোয়াল। এসব রাঘববোয়াল ধরতে না পারলে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা কোনো দিনও দূর হবে না। চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য সরকারি কিম্বা বেসরকারি হাসপাতাল যেখানেই যাওয়া হোক হয়রানি হতেই হবে।

বহু দিন ধরে স্বাস্থ্য খাতে যে অনিয়ম চলে আসছে সেটি দূর করে স্বাস্থ্য খাতের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরভিত্তিক বড় বড় হাসপাতালেই কেবল নজরদারি বাড়ানো হলে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে এ খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। আশা করছি, স্বাস্থ্য খাতের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে।

লেখক : শিক্ষার্থী

প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close