reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পর্যালোচনা

ভুট্টা উৎপাদনে নীরব বিপ্লব

নিতাই চন্দ্র রায়

ধান, সবজি ও মাছের মতো বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদনে ঘটেছে এক নীরব বিপ্লব। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে শস্যটির উৎপাদন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টন। আর গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ লাখ টনে। এ বিপ্লবের নেপথ্যের নায়ক হলেন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পরিশ্রমী কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা, কৃষিবিজ্ঞানী এবং ভুট্টার উচ্চফলনশীল হাইব্রিড বীজ বিপণনকারী বেসরকারি কোম্পানিগুলো।

আজ থেকে ৭-৮ বছর আগে সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে কর্মরতকালে দিনাজপুর জেলার মাঠে মাঠে ঘুরে কৃষকের মধ্যে ভুট্টা চাষের প্রবল আগ্রহ প্রত্যক্ষ করেছি। আগাম আমন ধান কাটার পর কৃষক সঙ্গে সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি আলুর চাষ করেন। তারপর আলু উঠিয়ে সামান্য একটি চাষ দিয়েই সেই জমিতে ভুট্টার বীজ বপন করেন। স্বামী লাঙল দিয়ে ভাউর তৈরি করছেন, স্ত্রী পেছনে পেছনে ভুট্টার বীজ বপন করছেন । আর তাদের সন্তান পায়ের সাহায্যে মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দিচ্ছে। ফসল চাষে পারিবারিক শ্রম ব্যবহারের কী অপরূপ দৃশ্য! না দেখলে বোঝানো যাবে না।

প্রতি বছর দেশে প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাড়ছে ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার। এতে ভুট্টার একটি বাজার তৈরি হয়েছে। চাহিদা থাকায় চাষ বাড়ছে। ফলনেও সাফল্য এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের বীজ ব্যবহারের কারণে এ অঞ্চলে ভুট্টার সর্বোচ্চ ফলন হচ্ছে বাংলাদেশে। হেক্টরপ্রতি ফলনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

মার্কিন কৃষি বিভাগের আগস্ট-২০২০-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা করেছে যে, গত মৌসুমে বিশ্বে হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ফলনের রেকর্ড করেছে তুরস্ক। দেশটিতে হেক্টরপ্রতি গড়ে ভুট্টা ফলেছে সাড়ে ১১ টন। অথচ এক বছর আগেও ফসলটির হেক্টরপ্রতি গড় ফলনে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হেক্টরপ্রতি সাড়ে ১০ টন ভুট্টা ফলিয়ে এবার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ভুট্টা ফলেছে পৌনে ১০ টন। দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। তবে ভুট্টা উৎপাদনের অর্ধেকই হয় রংপুর বিভাগে। উৎপাদনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ। জেলা হিসেবে দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে ভুট্টার আবাদ হয় বেশি।

ভুট্টা চাষের সুবিধাসমুহ : ১. ভুট্টার চাষের জমিতে আলু ও আমন ধানসহ তিনটি ফসলের চাষ করা যায়। ২. ধান ও গমের চেয়ে উৎপাদন খরচ কম এবং ফলন অনেক বেশি। ৩. বাজারে চাহিদা প্রচুর। ৪. তুলনামূলকভাবে অন্য মাঠ ফসলের চেয়ে লাভ বেশি। ৫. ভুট্টার বীজ ছাড়ানো মোচা ও শুকনা গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ৬. আলু তোলার পর ওই জমিতে সামান্য একটি চাষে ও স্বল্প পরিমাণ সার প্রয়োগ করে ভুট্টার চাষ করা যায়। ৭. ভুট্টা মাড়াই, মোচা থেকে বীজ সংগ্রহ, শুকানোসহ নানা কাজে নারী শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করতে পারেন। এতে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ৮. ভুট্টা বিদেশে রফতানিও করা যায়।

মানুষের খাদ্য হিসেবে ভুট্টা খুব উন্নত মানের। বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার মেক্সিকো, চিলি, মধ্য আমেরিকা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার বহু দেশে ভুট্টা প্রধান খাদ্যশস্য। বাংলাদেশের মানুষও ভুট্টা এখন সেদ্ধ বা পুড়িয়ে খাওয়া শুরু করেছে। রুটি, আটার সঙ্গে মিশিয়ে রুটি, পুরি, ভুট্টার বিস্কুট, ভুট্টার খিচুড়ি, ভুট্টার চাল খিচুড়ি, ভুট্টার পোলাও কতভাবেই না ভুট্টাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে মানুষ। ভুট্টার পপকর্নতো দিনে দিনে শহরাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চালের তুলনায় ভুট্টায় আমিষ, ফসফরাস ও চর্বির পরিমাণ থাকে বেশি। ভুট্টাবীজে তেলের পরিমাণ ৬ থেকে ৭ ভাগ। ভোজ্য তেল হিসেবে ভুট্টার তেল উত্তম। এ ছাড়া ভুট্টা স্টার্চ ও সিরাপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ভুট্টা থেকে উৎপাদিত ইথানল জৈব জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় অনেক দেশে।

শেরপুরের নকলা উপজেলার পাইশকা গ্রামের কৃষক আবু বক্কর ছিদ্দিক ১২ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের ভুট্টা চাষ করে ফলন পান ১২ মণ। এই পরিমাণ জমিতে ভুট্টা চাষে বীজ, সার, সেচ ও মজুরিসহ তার খরচ হয় ২ হাজার ৩৪০ টাকা। তিনি উৎপাদিত ভুট্টা বিক্রি করেন ৭ হাজার ২০০ টাকা। এতে তার একরপ্রতি খরচ হয় ১৯ হাজার ৫০০ টাকা এবং লাভ হয় ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। ওই জমিতে দুবার ধান চাষ করেও এত টাকা লাভ করা সম্ভব হবে না। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ভুট্টাচাষিদের কাছ থেকে জানা যায়, ভুট্টা চাষে প্রতি বিঘায় হাল, বীজ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ বাবদ প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার খরচ হয়। প্রতি বিঘায় ভালো মানের ভুট্টার হলে ফলন হয় ৩৫ থেকে ৪০ মণ। মৌসুমে প্রতি মণ ভুট্টা বাজারে বিক্রি হয় গড়ে ৫০০ টাকা মণ দরে। সে হিসেবে প্রতি বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষে কৃষকের লাভ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।

দেশে শীত ও গ্রীষ্ম এই দুই মৌসুমেই ভুট্টার চাষ হয়। তবে মোট উৎপাদনের ৮৭ শতাংশই হয় শীত মৌসুমে। এলাকাভেদে ফসল সংগ্রহ করা হয় মার্চ থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত। উৎপাদন মৌসুমে দেশে ভুট্টা আমদানির কোনো প্রয়োজন হয় না। এ কারণে ভুট্টা আমদানির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৫ লাখ টন ভুট্টা আমদানি হয়েছিল। গত অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ লাখ টনে। দেশে প্রাণী খাদ্যের বাজার বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে। প্রাণী খাদ্য তৈরির বড় অংশই আসে ভুট্টা থেকে। এরমধ্যে মুরগির খাদ্য তৈরিতে ৫৫ শতাংশ ভুট্টার দরকার হয়। এ হার গবাদিপশুর খাদ্যে ৩০ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। এ তিন খাতে বছরে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন ভুট্টার চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে দেশে ভুট্টার বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে দেশে ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার। আর বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকার।

বিশ্বে উৎপাদিত মোট ভুট্টার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো চারটি দেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৩৬.৬ মিলিয়ন টন ভুট্টা উৎপাদন করে বৈশ্বিক ভুট্টা উৎপাদনের শীর্ষস্থানে রয়েছে। দেশটিতে ৯০ মিলিয়ন একর জমিতে বছরে ভুট্টার চাষ হয়। উৎপাদিত ভুট্টার অর্ধেক অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহার হয় এবং বাকি অর্ধেক রফতানি করা হয় বিভিন্ন দেশে। বৈশ্বিক ভুট্টা উৎপাদনে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশটিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫৭.৭ মিলিয়ন টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়, যার সম্পূর্ণ অংশই দেশটিতে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহৃত হয়। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা বছরে ৪৬ মিলিয়ন টন ভুট্টা উৎপাদিত হয় এবং দেশের প্রয়োজন মেটানোর পর অর্ধেক ভুট্টা বিদেশে রফতানি করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইউক্রেনে ৩৫.৫ ও ভারতে ২৬ মিলিয়ন টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভুট্টার বৈশ্বিক রফতানি বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩.৯ বিলিয়ন ডলারে। বৈশ্বিক ভুট্টা রফতানি বাজারে যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইউক্রেন, ফ্রান্স, রুমানিয়া ও রাশিয়ার অংশ যথাক্রমে ৩৮.০, ১২.৫, ১২.১, ১০.৩, ৫.০, ৩.০ ও ২.৫ শতাংশ। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের অংশ হলো যথাক্রমে ১.৩ ও ০.৮ শতাংশ।

বিদেশেও ভুট্টা রফতানির সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। গত অর্থবছরে নেপালে ১ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ১৪৬ কোটি টাকা মূল্যের ভুট্টা রফতানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। ভুট্টা রফতানির জন্য আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, প্যাকেজিং কৌশলসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। এসব কর্মকান্ড সঠিকভাবে করা সম্ভব হলে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের ভুট্টার চাহিদা ও রফতানি বাড়বে। কৃষকও পণ্যটির ন্যায্যমূল্য পেয়ে লাভবান হবেন।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close