reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মুক্তমত

যস্মিন দেশে যদাচার

পঞ্চানন মল্লিক

প্রবাদ আছে ‘যস্মিন দেশে যদাচার’। প্রবাদবাক্যটি আমাদের অনেকের হয়তো আগে শোনা হয়নি। তবে আমরা সবাই মোটামুটি এর অর্থ বুঝতে পারছি। এটি বলতে বোঝানো হয়েছে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী যেখানকার মানুষ যে রীতি-নীতি মেনে চলে, সেখানে গেলে আমাদের সেগুলোই মেনে চলতে হয়। এ ছাড়া গত্যন্তরও খুব একটা থাকে না। কোনো অঞ্চলের প্রচলিত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে কাজ করাটা অনেকটা বেমানান। তেমন অবস্থায় পড়লে সেখানকার নিয়ম মেনে নিয়ে সেই অনুয়াযী পরিস্থিতি উত্তরণের পথ খোঁজাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ। পৃথিবীতে সবাই সব কাজ একভাবে করে না। যেখানে যেমন পরিবেশ, সেকানকার মানুষ সেভাবেই কোনো কাজে অভ্যস্ত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা যদি কখনো বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত সুন্দরবন ভ্রমণে যাই, তাহলে আমরা দেখতে পাব সেখানে যারা বসবাস করছেন, তারা অধিকাংশই সাগরের লোনাপানিকে সঙ্গী করেই দিনযাপন করছেন। বিশেষ করে সমুদ্রে যেসব মৎস্যজীবী বা জেলেরা মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তারা শুধু খাওয়ার পানিটুকুই ডাঙা বা লোকালয় থেকে ড্রামে করে নিয়ে যান। এ ছাড়া গোসল, ধোয়াপালাসহ অন্য সব কাজে লোনাপানি ব্যবহার করা ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর থাকে না। সমুদ্রে যারা মাছ ধরতে যান তারা প্রায় সবাই কোনো না কোনো মিষ্টিপানির এলাকার মানুষ। কিন্তু জীবিকার তাগিদে যখন সমুদ্রে যান তখন তাদের লোনা পরিবেশেই অভ্যস্ত হতে হয়। এমনিভাবে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে কাজ করাটাই মঙ্গল। এজন্য বলা হয়ে থাকে, ‘রোমে গেলে রোমান হও।’

পরিস্থিতি বুঝে কাজ না করলে হীতে বিপরীত হতে পারে। ধরেন, আপনি এমন কোনো জায়গায় গেলেন, যেখানে কোনো রিকশা বা দামি যানবাহন নেই। চলাচলের জন্য সবাই যাত্রি ভ্যানে চড়েন অথবা পায়ে হেঁটে চলেন। আপনি অমর্যাদাকর মনে করে তা করলেন না, ভালো কোনো যানবাহনের অপেক্ষায় বসে থাকলেন। শেষে দেখা গেল গন্তব্যেই পৌঁছাতে পারলেন না। অথচ ভ্যানে চড়লে বা হাঁটলে আপনি কিন্তু অতি সহজেই আপনার নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারতেন। তাই পরিবেশ পরিস্থিতিগত কারণে যেখানে ভ্যানে চড়া বা হাঁটা চলাচলের একমাত্র মাধ্যম, সেখানে শহুরে ঠাঁটবাট বা কেতাদুরস্তভাব পরিহারই বাঞ্ছনীয়। তেমনিভাবে এক জায়গার আচার-অনুষ্ঠান, নিয়মকানুন, রীতিনীতি অন্য জায়গার সঙ্গে সব সময় মেলে না। উদাহরণস্বরূপ আমাদের গাঁয়ে যেসব রীতিনীতি, প্রথা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি প্রচলিত আছে, সেগুলো শহরে অনেকটাই বিলুপ্ত। আবার একইভাবে শহরের কৃষ্টি-কালচার গ্রামের ক্ষেত্রে বেমানান। আমরা বাঙালি জাতি। আমাদের নিজস্ব কিছু রীতিনীতি, ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান বা সংস্কৃতি আছে। সেখানে বিদেশি কালচার বেমানান। কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে, একটি অন্যটির সঙ্গে মিশে সবকিছু যেন একেবারে গুলিয়ে ফেলছে। যেমন কথা বলার সময় বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে আমাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির এবং ভাষাগত উচ্চারণের বিকৃতি ঘটছে। এটি আদৌ কাম্য নয়।

আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা এবং মননে ব্রতী না হয়ে বিদেশি কালচারে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি। এটি আমাদের জন্য ক্ষতিকারক। ‘যদা দেশে যদাচার’ এটি না থাকলে এলাকাভিত্তিক মানবসমাজে প্রচলিত স্বাতন্ত্র্য রীতিনীতি, প্রথা, কানুন বজায় রাখা সম্ভব হবে না। ফলে অনেক সংস্কৃতি বিলুপ্ত হবে। ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক সংস্কৃতির উৎকৃষ্টতার জন্য বিশ্বের একেক অঞ্চল একেকভাবে খ্যাত হয়ে আছে। সেই অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করেন। সেখানে বিভিন্ন কৃষ্টি-কালচারের মিশ্রণে একটা বিপর্যয় ঘটতে পারে। অপমৃত্যু হতে পারে সেখানকার নিজস্ব সংস্কৃতির। তাই অপসংস্কৃতি, বিদেশি সংস্কৃতি ইত্যাদির কবল থেকে সেসব এলাকার নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষার একান্ত প্রয়োজন রয়েছে। আমরা অপরের সংস্কৃতিকে অবশ্যই শ্রদ্ধার চোখে দেখব; কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতির যেন তাতে বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয়, সেদিকেও সমান খেয়াল রাখবো। আজকাল তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অতি সহজেই আমরা অপরের শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে, বুঝতে পারি। তা ছাড়া বৈশ্বিক যোগাযেগের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে আমারা এখন অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত বা ভ্রমণ করে থাকি। এ কারণে নতুন নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সহজেই পরিচয় ঘটতে পারে। তাই বলে সেসব সংস্কৃতিতে আমরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ব, এমন নয়। বরং আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য ইত্যাদি নিয়ে বহির্বিশ্বে আমরা যাতে গর্ব করে দাঁড়াতে পারি সে উদ্যোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমরা যখন বিদেশে যাব, তখন প্রয়োজনে সেখানকার ভাষা, সংস্কৃতি আমরা অনুসরণ করব। কিন্তু আমরা যখন দেশে থাকি, তখন তো আমরা মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালি। তাই ষোলোআনা বাঙালি আনা আমাদের বজায় রেখে চলতে হবে। আমাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, প্রথা, অনুষ্ঠান আমাদের মতো করে চিরাচরিত নিয়মে প্রতিপালন করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই এর ব্যতিক্রম, বিকৃতি, ত্রুটিপূর্ণভাবে বা বিদেশি আদলে এগুলো করা চলবে না। আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ আমাদের থাকতে হবে। এগুলোর প্রতি আমাদের অনুরাগ যত গভীর হবে, বিদেশি কালচারে আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা তত কমবে। ধুম করে বিদেশি কেতা শেখার কী দরকার আছে? বরং আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভাবধারা হৃদয়ে লালনের মাধ্যমে বিশ্বের মধ্যে এর ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে। আমরা যেন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে সন্তুষ্ট থেকে চিরদিন গর্ব করতে পারি এবং বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারি বাঙালির ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-সমৃদ্ধির মাপকাঠিতে কারো তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। গভীর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে আমরা আমাদের সংস্কৃতির মতো করে পালন করব এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close