নিবন্ধ
দৈনতা আমাদের সংস্কৃতির নয়
স্বপ্নীল রায়
কয়েক দশক আগেও দেশে এত চ্যানেল ছিল না। বিটিভি দেখে সময় কেটেছে। আমরা যারা শুধু বিটিভি থাকার যুগে টেলিভিশন দেখেছি, তারা বিষয়টা জানি। কারণ তখন এখনকার মতো ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। তবে তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। এসব সিরিয়াল দেখার জন্য মানুষ যেসব বাড়িতে টিভি ছিল, সেখানে ভিড় জমাত। প্রচুর দর্শক ছিল সেসময়ও। আজও আছে। কিন্তু একটা কথা বলতে হয়, সেসময় যেমন বিদেশি সিরিয়াল জনপ্রিয় ছিল বিপরীতে বিটিভিতে প্রচারিত নাটকও ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সেসময় প্রচারিত কোথাও কেউ নেই, অয়োময়সহ অনেক নাটক, নাটকের সংলাপ, অভিনেতা সবাই ছিল জনপ্রিয়। আমরা সেসব নাটকের কথা আজও মনে রেখেছি। এখানে নাটকের কাহিনি, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কলাকুশলী, নাটকের ডায়ালগ প্রতিটি বিষয় আকর্ষণ করত। তবে এখনকার কথা ভিন্ন। রিমোট কন্ট্রোলের যুগে একটু ভালো না লাগলেই পছন্দ পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। তখন এ সুযোগ ছিল না। তবে এটাও ঠিক যে, একটা বইয়ের কাহিনি পাঠককে বইয়ে ধরে রাখে। সেই বই নিঃসন্দেহে সার্থক বই। তেমনি একটা নাটকেরও একই ক্ষমতা থাকা জরুরি। নাটকের গল্পই দর্শককে নাটকে ধরে রাখবে। আজকাল নাটক প্রচারের কত মাধ্যম। ইউটিউব রয়েছে, রয়েছে আরো মাধ্যম। মজার ভিডিও আপলোড করে জনপ্রিয়তার তকমা লাগছে গায়ে। অমুক হিট, তমুক হিট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হিট ব্যক্তিদের পদচারণা রয়েছে। তাদের বহু বহু ফলোয়ার থাকে। কিন্তু এসব কোনো সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা? এটা তো আমরা নই। নিজেদের রাস্তা থেকে আমরা সরে এসেছি।
একটা নাটক বা সিনেমা দেখার জন্য ভিড় জমাত লোকজন। তখনো আকাশ সংস্কৃতি শব্দটির এত প্রচলন হয়নি। সবার ঘরে টেলিভিশনই ছিল না। এখন যেমন এক বাড়িতে প্রতি ঘরেই টেলিভিশন আছে। চ্যানেলের পর চ্যানেল। হাতে রিমোট ঘোরে। এক চ্যানেল থেকে আরেক চ্যানেল। তারপর একসময় ভিনদেশি সংস্কৃতির দিকে আমরা ঝুঁকতে থাকি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে থাকে। আমরা পোশাকে-আশাকে, ব্যবহারে, চলনে অনুকরণ করতে শুরু করি। সেই ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে বিদেশি সংস্কৃতি মিশে এক মিশ্র সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। এর প্রভাব এতটাই যে, মাঝে মাঝে স্বকীয়তা খুঁজে বের করতেই কষ্ট হয়। বিদেশি সংস্কৃতি ভালোবাসতে গিয়ে নিজের সংস্কৃতি হারাতে বসেছি। নিজ সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়ার মূঢ়তার ভেতর আনন্দেরও কিছু নেই। বরং তা খানিকটার লজ্জার। এই লজ্জা আমরা পেতে ভালোবাসি। লজ্জাও আমরা মজ্জাগত করে নিয়েছি। আজ সকাল বিকেল রাতে টিভি বাইরের চ্যানেলে সিরিয়াল দেখা হয়। সেসব সিরিয়ালে দেখানো সংস্কৃতি আমাদের ছিল না কোনো দিন। আমাদের পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে খুব দ্রুত। দেশে একান্নবর্তী পরিবার গুঁড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। তারপর স্বামী, স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে পরিবার গড়ে উঠেছে। সেসব অনেক পরিবারেই আজ ভাঙনের সুর। স্বামী স্ত্রী আলাদা হচ্ছে। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। সন্তান আলাদা হচ্ছে তার বাবা অথবা মার কাছ থেকে। এভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। অপরাধ বাড়ছে। তাতে সিরিয়াল দেখার অভ্যাস কমেনি, বরং বেড়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে কীভাবে একটি সিরিয়াল মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে? সহজ কথায় মানুষ অনুকরণ করতে ভালোবাসে। অর্থাৎ কোনো নায়ক বা নায়িকা যে পোশাক ব্যবহার করে, সেই ধরনের পোশাক তৈরির প্রতি বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হয়। এভাবে সিরিয়ালে যখন পারিবারিক অশান্তি দেখানো হয়, কোন্দল দেখানো হয়, তখন তা ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব ফেলে। একসময় মন তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়। খুব কম মানুষই আছে যারা অনুকরণ বা অনুসরণ থেকে দূরে থাকতে পারে।
বাঙালি হিসেবে আমাদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাস্তবতা বলছে, সেই সমৃদ্ধ সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে বেশি ইচ্ছুক নই। আমরা একটু বেশিই অনুকরণপ্রিয়। অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি বন্ধক রাখতে বসেছি। এখন আমাদের জগাখিচুড়ি অবস্থা। মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আকাশ সংস্কৃতির প্রবেশের শুরুতে বয়স্ক স্থানীয়রা চোখ বন্ধ করে ছি ছি করত। এখন ছোট-বড় প্রভেদ নেই। সেসব সংস্কৃতি নিয়েই মেতে থাকতে পছন্দ করি। সবই তো আজকাল ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে গেছে। পোশাকে ফ্যাশন, কথা বলায় ফ্যাশন, চলায় ফ্যাশন। এই মিথ্যে সাজগোছ আজকাল বড় ফ্যাশন। অথচ প্রথম দিকে আমরা ভাবতাম একটুখানি ওসব বাইরের নাচ গান বা তাদের স্টাইল ফলো করলে ক্ষতি আর এমনকি হবে। এতে এতটা ভাবার কিছু নেই। আর এখন কি তাই করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওসব অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে আজকাল রিমোট যুদ্ধ চলে। যে ঘরে একটা টিভি রয়েছে সেসব অনেক পরিবারেই কাউকে না কাউকে সেক্রিফাইস করতে হয়। না হলেই দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব থেকে মহাদ্বন্দ্ব! এ যুগে যখন টিভি পর্দার সামনে বসে ভারতীয় বাংলা বা হিন্দি চ্যানেল দেখে আবার কথা বার্তায়, পোশাকে-আশাকে, খাবার দাবারে বাঙালি সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে সেদেশে সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরে থাকি; তখন শুধু আগ্রাসন শব্দটি বেমানান মনে হয়। যা ঘটে গেছে তাকে আর আগ্রাসন বলে লাভ নেই। ইতিমধ্যেই সেগুলো আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। এখন তো বিসর্জন বাকি। তবে সেটুকুও যাওয়ার পথে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নায়ক নায়িকার জামা কাপড়ের সঙ্গে মিল রেখে পোশাক কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করা আর না পেলেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়া অথবা স্বামীকে ছেড়ে সংসার ফেলে চলে যাওয়া, আবার মেকআপে রং ঢংয়ে সবকিছুতেই যখন নিজ দেশের কোনো ছাপই থাকে না, তখন বুঝতে হবে আমরা কোথায় পৌঁছে গেছি! আমাদের সংস্কৃতিবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আমাদের ভাষায়, আমাদের পোশাকে, আচার আচরণে, সৌহার্দবোধে যেন বিদেশি সংস্কৃতি অনুসরণ করাই মূল কাজ। নিজেদের অনেক কিছু ভুলতে ভুলতে এতটাই ভুলে গেছি যে, অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভারতীয় চ্যানেল এবং সেখানে প্রচারিত নাটক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে তুমূল সমালোচনা হয়। সেসব নাকি আমাদের পারিবারিক কলহ সৃষ্টি করছে। তখন মনে হয়, আমরা অনেকেই নিজের সংস্কৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
আবার বিপরীতে কেউ কেউ সেগুলো টেনে আনার পক্ষে। কিন্তু ঠিক কোথায় আমরা অসহায়। আজকাল হাতে হাতে মোবাইল। ইন্টারনেটের বদৌলতে আমরা পৌঁছে যাই, পরিচিত হই ভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে। ঠিক সে রকমভাবে কিন্তু সেসব দেশের মানুষও আমাদের সংস্কৃতি আমাদের রুচি বোধ বিষয়ে জানতে পারে। কিন্তু আমরা যেভাবে বিদেশি আচার নিজের ভেতর ধারণ করে নিজেরটা ভুলতে থাকি, অন্যদেশের কেউ তা করে কি। আমি নিশ্চিত করে না। কারণ আমরা শুধু পরিচিত হয়েই খুশি থাকি না। আমাদের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে তা নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার পর্যায়ে যায়নি। নাটকের ফাঁকে বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে আমাদের দর্শকদের অভিযোগের অন্ত নেই। সত্যি কথা কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো নাটক ভালো লাগলেও শুধু প্রচুর বিজ্ঞাপনের কারণে দর্শক নাটকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আমাদের দেশের নাটকের মান অনেক ভালো বলে আমার মনে হয়। বর্তমান প্রজন্মে অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও দক্ষ। পরিচালক-প্রযোজকরাও জনপ্রিয়। তবে কেন ভিনদেশি সিরিয়ালে চোখ থাকবে? ফিরতে হবে আপন আলয়। নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি, নিজের অস্তিত্ব এসব বিলিয়ে দিলে আর কিছ্ইু অবশিষ্ট থাকে না। টিকে থাকা যায় হয়তো। তবে দীনতা নিয়ে টিকে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভালো।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"