reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৬ আগস্ট, ২০২০

দৃষ্টিপাত

করোনার টিকা আবিষ্কারে এগিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান

জান্নাতুন নিসা

পৃথিবী এখন মানুষের হাতের মুঠোয়; আকাশ থেকে মাটি, সাগর থেকে পাহাড় সবকিছুই আমাদের নখদর্পণে। আর তাই হয়তো ক্ষমতার দাপটে ভর করেই অনিয়ম আর অনিয়ন্ত্রিত জীবনবোধের সাহচর্যে নিজেদের জয়ী করতে প্রকৃতির ওপর বড্ড বেশি অত্যাচার করেছি আমরা। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে কেবলই আমাদের অর্থাৎ মানুষের জয়গান বাজিয়েছি। দিগবিদিক জয়ের ডামাডোল বাজাতে বাজাতে আমরা বেমালুম ভুলে গেছি সৃষ্টির সহস্র নিয়মের কথা, ভুলে গেছি পৃথিবীতে বর্তমান সব সৃষ্টির কথা; পৃথিবী যে কেবল মানুষের একার নয় সেই কথা! তাই বুঝি নিশ্চুপ প্রকৃতি আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাবৎ বিশ্বকে করোনাভাইরাসের অদ্ভুত আলিঙ্গনে গ্রীষ্মের দাবদাহেও শীতলতায় ঘেরা জন্ম-মৃত্যুর খেলায় বন্দি করেছে। তবে সেই বন্দিদশা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে মহামারি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে গবেষক মহল টিকা (ভ্যাকসিন) তৈরির লক্ষ্যে ছুটছেন ব্যস্ত হয়ে। যদিও একেকটি টিকার পরীক্ষা-পর্ব সারতেই সাধারণত বছরের পর বছর সময় লাগে। তবে কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে তা ১২ থেকে ১৮ মাসে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।

বেশ কটি ধাপ পেরিয়ে টিকা মানব শরীরে ব্যবহার উপযোগী হয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের তথ্যানুযায়ী, টিকা বা ভ্যাকসিন মূলত ভাইরাসের প্রতিরূপ বা ভাইরাসেরই অংশ, যা সুরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে জাগিয়ে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করে। তবে টিকা তৈরির ক্ষেত্রে অন্য ওষুধের চেয়ে উন্নত নিরাপত্তা মান বজায় রাখতে হয়। কারণ এটি লাখো মানুষের শরীরে দেওয়া হয়ে থাকে। টিকা মূলত কয়েকটি ধাপে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। ধাপগুলো হলো-১. প্রি-ক্লিনিক্যাল ধাপ, ২. পরীক্ষার প্রথম ধাপ, ৩. দ্বিতীয় ধাপ এবং ৪. তৃতীয় ধাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৪ জুলাইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের কার্যকর টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অন্তত ১০টি দেশে চলছে প্রায় ১৭৩টি উদ্যোগ। এই যে টিকা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে সেখানে প্রচলিত ধাপগুলো পেরিয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি উদ্যোগ পৌঁছুতে পেরেছে পরীক্ষার প্রায় শেষ ধাপে।

ধাপগুলোর প্রথম পর্বকে আমরা প্রাক ক্লিনিক্যাল পর্ব হিসেবে জানি এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বেশির ভাগ প্রচেষ্টাই এখনো প্রাক ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে রয়েছে। এই ধাপে বিজ্ঞানীরা ভাইরাস বা তার কোনো একটি অংশ তৈরি করেন। সেটি অন্য প্রাণীদের ওপর প্রয়োগ করে দেখেন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিকঠাক সাড়া দিচ্ছে কিনা। এখন পর্যন্ত এই পর্যায়ে আটকে আছে প্রায় ১৪০টি প্রচেষ্টা। এরপর দ্বিতীয় পর্বের প্রথম ধাপ। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার প্রথম ধাপে সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যে টিকাটি প্রয়োগ করে দেখা হয়। দেখা হয়, প্রাক ক্লিনিক্যাল পর্বে পশুর দেহে যেভাবে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, মানুষের শরীরেও তা একইভাবে কাজ করছে কিনা। বর্তমানে ১৯টি টিকা রয়েছে এই ধাপে। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে এখন পর্যন্ত পৌঁছুতে পেরেছে প্রায় ১১টি টিকা। সম্ভাব্য টিকাটি কতটা নিরাপদ আর তা কী মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে, এই ধাপে মূলত সেটি দেখেন বিজ্ঞানীরা। এজন্য কয়েকশ’ মানুষের শরীরে টিকাটির পরীক্ষা করা হয়। তৃতীয় ধাপে টিকা প্রয়োগের পরীক্ষার আওতায় আসেন কয়েক হাজার মানুষ। কার্যকারিতা, শরীরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার দিকগুলোতে এই পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা মনযোগ দেন। এই ধাপে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর মাত্র তিনটি সম্ভাব্য টিকা পৌঁছেছে। এরপর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে তা বাজারজাত করার অনুমোদন দেয় দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই তিনটির মধ্যে শুরু থেকেই আলোচনায় এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে তারা। পৌঁছে গেছে তাদের উদ্ভাবিত টিকা পরীক্ষার শেষ ধাপে। দক্ষিণ আফ্রিকা আর ব্রাজিলে চলছে তার ট্রায়াল। আর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে পৌঁছানো তিনটি টিকার মধ্যে বলা হচ্ছেÑ এখন পর্যন্ত দুটিই চীনের। এর মধ্যে নিষ্ক্রিয় ভাইরাস থেকে টিকা তৈরি করেছে সাইনোভেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক ধাপগুলো অতিক্রম করে এটিরও তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চলছে ব্রাজিলে।

নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যানুযায়ী, সাইনোভেকের ইনঅ্যাক্টিভেটেড করোনাভ্যাক টিকাটি প্রয়োগে এখন পর্যন্ত কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি এবং প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বিষয়টিকে জয়ের পথ ভেবে বাজারজাত করতে বার্ষিক প্রায় ১০ কোটি ডোজ তৈরির জন্য কারখানা তৈরি করছে তারা। ক্যানসাইনো নামের প্রতিষ্ঠানের অন্য টিকাটিরও দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে সামরিক বাহিনীকে তা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে চীন। তবে ১৭ জুলাইয়ের পর শেষ ধাপের এই পথ পরিক্রমায় নতুন করে যোগ দিয়েছে মার্কিন কোম্পানি মডার্না। যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ হাজার মানুষের ওপর টিকাটি প্রয়োগের পরিকল্পনা করেছে তারা। যতদূর জানা যায়, ট্রায়াল পর্ব শুরু হয়েছে ২৭ জুলাই থেকে। এই গবেষণাটি ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য তাদের। তবে তার আগেই প্রাথমিক ফলাফল জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের করোনা ট্র্যাকার অনুযায়ী, টিকা তৈরির ক্ষেত্রে আরো অনেকেই এগিয়ে আছেন। এর মধ্যে জাপানের জৈবপ্রযুক্তি উদ্যোগ অ্যানজিস ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু করেছে। আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে করোনার ভ্যাকসিনের ১০ লাখ ডোজ উৎপাদন করতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি। ভারতের হায়দ্রাবাদভিত্তিক ভারত বায়োটেক ‘কোভ্যাক্সিন’ নামের একটি টিকা উৎপাদনে সফল হওয়ার দাবি জানিয়েছে। বিশ্বজুড়ে টিকা তৈরির যে প্রতিযোগিতা চলছে, এতে তারা ভারতের প্রথম প্রার্থী। এই টিকা তৈরিতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি (এনআইভি) নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের একত্রে কাজ করার কথা। তারা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু করছে। অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি ভ্যাক্সিন প্রথম ধাপে এই টিকা বা ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু করেছে বেশ আগেই। এর মাঝে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগের ইতিবাচক ফল পাওয়ার কথা জানিয়েছে মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান কোম্পানি বায়ো এন টেক। প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের টিকা প্রয়োগের ইতিবাচক ফল জানিয়ে দাবি করেছে, এটি স্বাস্থ্যবান মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও করোনাভাইরাস টিকা প্রয়োগের ছোট আকারের একটি পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়ার দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ছোট্ট বায়োটেক কোম্পানি ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালের গবেষকেরা।

আমাদের দেশেও অর্থাৎ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ মাসেই চীনের করোনার টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাই বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগের অনুমোদন দেয়। এই পরীক্ষায় বাংলাদেশের মোট ২ হাজার ১০০ জনের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হবে। বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) পরিচালক ডা. মাহমুদ-উজ-জাহানের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বেইজিংয়ের টিকা প্রয়োগের অনুমতি চাওয়ার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয় এ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), চীনা প্রতিষ্ঠান সাইনোভেকের অংশীদার হিসেবে এই পরীক্ষা চালাবে এবং এর পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তাদের সব অফিসিয়াল কার্যক্রম শেষ হলে প্রাথমিকভাবে সরকারি সাত থেকে আটটি কোভিড হাসপাতালে এ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা রয়েছে। হাসপাতালগুলো হচ্ছেÑ মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিট-১, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইউনিট-২ এবং ঢাকা মহানগর হাসপাতাল। এর মাঝে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ অব কোম্পানিজ লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড কোভিড-১৯ এর টিকা উদ্ভাবনের দাবি করেছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান এই টিকা উদ্ভাবনের দাবি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্যানুযায়ী তারা গত ৮ মার্চ এই টিকা তৈরির কাজ শুরু করে। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সব ধাপ পার হতে পারলে আগামী ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে টিকা বাজারে আনা সম্ভব হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারীনেত্রী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close