ডা. মো. আরিফ মোর্শেদ খান

  ১২ এপ্রিল, ২০২০

বিশ্লেষণ

করোনা রোগীকে ঘৃণা করার আগে ৫ মিনিট নিজের শ্বাস বন্ধ রাখুন!

সকাল ৬টা!

ডা. রাসেলের (ছদ্মনাম) ফোন।

কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, ‘স্যার, বাবার শ্বাসকষ্টটা অনেক বেড়ে গেছে। এত দিন রাজি না হলেও আজ শ্বাসকষ্ট একদমই সহ্য করতে না পেরে গলায় ফোটা করে শ্বাস নেওয়ার সহজ বিকল্প ব্যবস্থা করতে রাজি হয়েছেন।’

আমি বললাম, ‘যাক, আলহামদুলিল্লাহ, চাচা রাজি হলেন তাহলে। রাসেল, তোমার বাবাকে এখনই ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসো! তার ট্রাকিওস্টমি করতে হবে, এখনই।’ ডা. রাসেলের বাবা গলার ক্যানসারের রোগী।

ফোনের ওই প্রান্তে রাসেল এবার হাউমাউ করে কাঁদল : ‘স্যার, বাসায় আমি ছাড়া কেউ নেই। আব্বাকে ধরে নিচে নামানোর জন্য পাশের বাসার বাড়িওয়ালার ছেলের সাহায্য চাইতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। শ্বাসকষ্টের কথা শুনে সবাই ‘করোনা নয়তো’ বলে যার যার মতো দূরে সরে গেল। একান, ওকান ছড়িয়ে বাবাকে নিয়ে এখন আমি রীতিমতো গৃহবন্দি। ফোনে গেটের দারোয়ানকে অনুরোধ করলে সে বলল, জীবন গেলেও বাবাকে ধরবে না সে!

ফোনের এপ্রান্তে আমি হতভম্ব! এ কী গুজবের, আতঙ্কের মধ্যে পড়লাম আমরা?

করোনা রোগীদের প্রতি মোটা দাগে একটা ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে। এর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না করোনায় মৃত ব্যক্তি ও তার স্বজনরাও! এমনকি আদৌ করোনা নয়, এমন অন্য রোগীরাও গুজবের তা-বে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার, অবহেলার, এমনকি (প্রতিরোধযোগ্য) মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন।

আচ্ছা আমায় বলুন, করোনায় মৃত ব্যক্তি কি এইডস রোগী, যে তিনি তার অপকর্মের(?) দায় শোধ করবেন? তিনি কি বারবার নিষেধ সত্ত্বেও অত্যধিক পরিমাণে মদ খেয়ে খেয়ে লিভার পচিয়ে ফেলা কেউ? বা সব ডাক্তারি উপদেশ অবজ্ঞা করা চেন স্মোকার, যিনি কেজি কেজি নিকোটিন ফুসফুসে জমিয়ে, দীর্ঘ মৃত্যুশয্যায় পরিবারকে চরম অর্থনৈতিক দৈন্যে ফেলে ইহধাম ত্যাগ করেছেন? না, তা তো নয়! করোনা নিয়তিতে তার খুব বড় কোনো অপরাধ বা দুর্নীতি নেই!

একই নিয়তি হতে পারে আমার বা আপনার! যে ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে আপনি রোগীকে ঘৃণা করছেন, সে ধরনের অসংখ্য ভাইরাস আমরা প্রতিদিন শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রাণভরে ফুসফুসে নিচ্ছি, আবার বেরও করে দিচ্ছি। আপনার বা আমার ক্ষেত্রে ভাইরাস লোড সুবিধা করে উঠতে পারেনি, এই যা! তবে আজ পারেনি বলে কাল তা পারবে না, তাও কিন্তু নয়!

যে আইইডিসিআর টেস্ট করছে না বলে ‘নো টেস্ট, নো পেশেন্ট’ লিখে আমরা সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করছি, তারাও কিন্তু এখন নতুন পাল্টা অভিযোগ শুরু করছেন এই বলে, ‘কখনো কখনো রোগীর পরিবার টেলিফোন করে ডাকার পর আমরা শেষ পর্যন্ত রোগীর বাড়িতে পৌঁছে দেখি, ইতোমধ্যে বহুমতে দ্বিধান্বিত, আতঙ্কিত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ‘না, আমরা টেস্ট করাব না!’

সম্ভাব্য কোভিড-১৯ রোগীর পরিবার ধরেই নিচ্ছে, অফিশিয়ালি রোগ ধরা না পড়লে অন্তত টিকে থাকব! কিন্তু সত্যিই করোনা ধরা পড়লে পুরো পরিবারকেই সমাজচ্যুত হতে হয় কি না, এই আশঙ্কা!

হায়! আমরা কি মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে ফেলে, ভীতি সঞ্চার করে, উল্টো করোনা রোগীদের ডায়াগনসিস বাধাগ্রস্ত করে, সমাজে আরো সংক্রমণ হওয়ার পরিবেশ তৈরি করছি না?

কারা করোনা হাসপাতাল নির্মাণে বাধা দিতে চেষ্টা করে? কারা গোরস্থানে ডিজিটাল ব্যানার টানায় যে, এখানে করোনা রোগী দাফন হবে না? কেন এদের শক্তহাতে দমন করা হবে না আজই? এখনই!

করোনাভীতিতে পিপিই না থাকা অরক্ষিত ডাক্তার রোগী দেখছে না বলছেন, কিন্তু যে করোনা হাসপাতালে রোগী দেখানো সম্ভব, সমাজে ভীতি ও ঘৃণা ছড়ালে রোগীকে ওই হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাবেন কী করে? করোনা বাদই দিলাম, গলায় বা ফুসফুসের ক্যানসার বা কিডনি রোগীর শ্বাসকষ্ট হলে লিফটবিহীন বহুতল ভবনের পঞ্চমতলা থেকে রোগী নামিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য বহুতল ভবনের সিঁড়িতে রোগী নামানো থেকে শুরু করে, সিএনজি, ট্যাক্সি বা রিকশায় বা অ্যাম্বুলেন্সে রোগী ওঠানামা ও মুভমেন্টে যে সাহায্য দরকার, সেটা পাবেন কোথায়?

একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ হিসেবে গলার ক্যানসারের কারণে (করোনা নয়) শ্বাসকষ্ট বেড়ে মৃত্যুমুখে পড়া যে রোগীকে হাসপাতালে এনে গলায় টিউব পরিয়ে নাটকীয়ভাবে সঙ্গে সঙ্গেই শ্বাসকষ্ট ভালো করে দিতে পারতাম, করোনা গুজবের ভয়ে তাকে অসহযোগিতা করে পালানো মানুষের জন্য বিনা চিকিৎসায় এই ক্যানসার রোগী শ্বাসবন্ধ হয়ে মারা গেলে তার দায় কে নিচ্ছে?

সরকার কী করছে বা না করছে, সেটার দায় সরকারের। কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমার দায় আমি কতটুকু পালন করছি?

করোনায় মৃত ব্যক্তি কাউকে ছুঁতে পারে না, শ্বাস নেয় না, সর্দি-কাশি দেয় না। এই নিথর দেহ তো কাউকে সংক্রমণ করবে না, যদি আমরা ভালোভাবে (আইইডিসিআরের গাইডলাইন নেটে ওদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে) জীবাণুমুক্ত ব্যাগে/বাক্সে লাশ ভরে ফেলি, তারপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সমাহিত করে, সমাহিত করার স্থান ও আশপাশের জায়গা জীবাণুনাশক স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করে ফেলি, তাহলেই তো কাজ শেষ!

করোনায় মৃত রোগীর স্বজনদের প্রতিও সহানুভূতিশীল হোন। নিরাপদ দূরত্ব (সোশ্যাল ডিসট্যান্স) মেনে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করুন। রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধে সতর্ক হোন, রোগীর বা মৃতের পরিবারের প্রতি ঘৃণা নয়!

আসুন সচেতনভাবে চিন্তা করি। ভেবে দেখুন, রাজপুত্র চার্লস, প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী যদি সংক্রমিত হতে পারেন, তাহলে আপনি বা আমি কেন নয়? এমনও হতে পারে, আমি বা আপনি করোনা রোগী হয়ে তেমন গুরুতর কোনো লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই আমরা ভালো হয়ে গেছি ইতোমধ্যে আমাদের অজান্তেই। ৮৫ শতাংশ করোনা রোগীর ক্ষেত্রে কিন্তু কাশি, সর্দি-জ্বর বা সামান্য শ্বাসকষ্টের চেয়ে বেশি কিছু নাও হতে পারে!

আসলে বিজ্ঞান বলছে, করোনাভাইরাসের উপস্থিতিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিদিন শ্বাস-প্রশ্বাসে আমরা যে অসংখ্য ভাইরাস শরীরে ঢোকাচ্ছি ও বের করছি, সেটা অস্বীকার করতে চাইলে শ্বাস বন্ধ করে থাকতে হবে। পারবেন? দেখান তো শুধু পাঁচ মিনিট শ্বাস বন্ধ রেখে?

তাই আসুন, ভীতি বা ঘৃণা ছড়ানো এখনই বন্ধ করি। আজকে আমার ঘৃণার পাতা ফাঁদে কাল করোনা রোগী হয়ে আমি নিজেই পা দেব না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গুজব, আতঙ্ক নয়; চাই সচেতনতা।

লেখক : নাক, কান, গলাবিশেষজ্ঞ ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close