দেবব্রত অধিকারী

  ১১ এপ্রিল, ২০২০

বিশ্লেষণ

হোম কোয়ারেন্টাইনে শিশুর শারীরিক ও মানসিক প্রভাব

অদ্ভুত এক অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। করোনাভাইরাস আজ বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নিয়েছে। করোনাভাইরাস এ মুহূর্তে মানবসভ্যতার জন্য সব থেকে বড় একটি চ্যলেঞ্জ, যার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। পৃথিবীর সব দেশ নিজেদের অবস্থান থেকে এ সমস্যা থেকে উত্তরণে কাজ করে যাচ্ছে।

আমাদের জীবনে করোনার প্রভাব বহুমুখী, এটি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করছে, সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়েছে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের জীবনেও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারা দেশের সব শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে, যেটি ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং করোনাভাইরাস মোকাবিলায় একটি যথোপযুক্ত প্রাথমিক উদ্যোগ। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

দীর্ঘকালীন স্কুল বন্ধ এবং একটি রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে গৃহবন্দি থাকার জন্য শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, শিশুরা যখন বিদ্যালয়ের বাইরে থাকেÑ যেমন সাপ্তাহিক ছুটি, গ্রীষ্মের ছুটি এবং অন্যান্য ছুটির সময়, তখন তারা শারীরিকভাবে কম সক্রিয় থাকে, অনেক বেশি সময় স্ক্রিনের সামনে কাটায়, ঘুমের অভ্যাস অনিয়মিত হয়ে যায় এবং ডায়েটিংয়ে সঠিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এর ফলে তাদের সার্বিক ফিটনেসে একটি প্রভাব পড়ে। এই নেতিবাচক প্রভাব আরো বেশি খারাপ হতে পারে, যখন শিশুরা ঘরে আবদ্ধ থাকে এবং তাদের সমবয়সি শিশুরদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ যেখানে থাকে না।

এ সময় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সব থেকে অবহেলিত বিষয় হলো, এ ধরনের ঘটনা কিশোর-কিশোরীদের মনস্তত্ত্বে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যেখানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সব বয়সের মানুষই উদ্বিগ্ন, সেখানে কিশোর-কিশোরীরা বয়সের হিসাবে এমন একটি জনগোষ্ঠী, যারা তীব্র আবেগি হয়ে থাকে।

আপাত দৃষ্টিতে পরিস্থিতির বিবেচনায় বিষয়টিকে খুব সামান্য মনে হলেও উদ্বেগের কারণ থেকে যায় যখন পত্রিকায় দেখি, রাজবাড়ীতে দুপুরে কিশোরকে বাড়ির বাইরে যেতে মা বাধা দেওয়ায় এক কিশোর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। (তথ্য সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন ২৬ মার্চ, অনলাইন)।

আমরা সত্যিই চাই না কিশোর-কিশোরীরা এভাবে হতাশার ভেতরে ডুবে যাক, আমরা আশাবাদী হতে চাই। আসলে দীর্ঘসময় ধরে সংক্রমণের আশঙ্কা, হতাশা, একঘেয়েমি, অপর্যাপ্ত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগের অভাব, বাড়িতে ব্যক্তিগত জায়গার অভাব এবং পারিবারিক আর্থিক ক্ষতির মতো স্ট্রেসগুলো শিশু এবং কিশোরদের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের পর, বাবা-মা এবং ইয়ুথদের মধ্যে পোস্টট্রোম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার সম্পর্কিত এক গবেষণায় দেখা যায়, গড়পড়তাজনিত স্ট্রেস স্কোরগুলো কোয়ারেন্টাইনে থাকা শিশুদের অন্য স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় ৪ গুণ বেশি।

তারপরও জীবন আচরণের পরিবর্তন এবং গৃহবন্দি অবস্থা শিশু মনোজগতে যে মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে, তা শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। হোম কোয়ারেন্টাইনে ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য সরকার, এনজিও স্কুল এবং বাবা-মায়ের পরিস্থিতিটির নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এটি অ্যাড্রেস করার জন্য আরো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্য মোকাবিলা করা কোনো দেশ থেকে অভিজ্ঞতা নেওয়া যেতে পারে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এই অস্থির সময়ে শিশুদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার শারীরিক এবং মানসিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংসদ টিভির মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রাখার একটি উদ্যোগ নিয়েছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, কোর্সগুলোর বিষয়বস্তু যেন শিক্ষাগত প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়, আর এ ক্ষেত্রে দরকার প্রয়োজনীয়র গাইডলাইনের। তা ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনজিওসহ শিক্ষাকার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে অনলাইন কনটেন্ট তৈরির উদ্যোগ নিতে পারে। পাশাপাশি সচেতনতামূলক ভিডিও তৈরি করে শিশুদের ঘরের মধ্যে অল্পবিস্তর শারীরিক কসরত, সুষম ডায়েট, নিয়মিত ঘুম এবং এ সময়ের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি পালনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এ ধরনের শিক্ষা ম্যাটেরিয়ালগুলো সত্যিই কার্যকর যদি, তা বয়স উপযোগী এবং আকর্ষণীয় হয়।

এ মুহূর্তে স্কুলের শিক্ষকরা মোবাইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং তাদের সঠিক পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে মনোসামাজিক সহায়তার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্কুলগুলো স্বাস্থ্যবিধি, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, ডায়েট ঘুমের অভ্যাস সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারে।

এ ধরনের হোম কোয়ারেন্টাইনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা শিশুদের যেকোনো ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য সব থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। শিশুদের সঙ্গে শারীরিক এবং মানসিক যোগাযোগ এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি বিচ্ছিন্নতায় শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং সান্ত¡না দেওয়ার মূল চাবিকাঠি হতে পারে। ছেলেমেয়েরা যখন হোম কোয়ারেন্টাইনের জাঁতাকলে পিষ্ট, সঠিক প্যারেন্টিং দক্ষতা তখন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুরা এ সময় প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাস সম্পর্কিত খবরের সংস্পর্শে আসবে, তাই তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলে সঠিক তথ্য দেওয়া, তার সামনে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ থেকে বিরত থাকা, শিশুকে আতঙ্ক এড়িয়ে সচেতন হতে সহায়তা করতে পারে। শুধু করোনাভাইরাস নিয়ে আলোচনা না করে অন্য অনেক বিষয় নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করা যেতে পারে, যা শিশু মনের ফোকাসকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে সহায়তা করে।

এই হোম কোয়ারেন্টাইন আমাদের সামনে একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, সঠিক প্যারেন্টিংয়ের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধনকে আরো জোরদার করা যেতে পারে। এ সময় স্বভাবতই সন্তানদের ভেতরে গৃহবন্দি থাকতে থাকতে একঘেয়েমি এবং হতাশা চলে আসতে পারে। এজন্য একটি সঠিক রুটিন করা অতি জরুরি। রুটিনের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষার পাশাপাশি তার বিনোদনের ব্যবস্থাও যেন থাকে। এজন্য ঘরে বসে যেসব ইতিবাচক বিনোদনগুলো গ্রহণ করা যায়, তার সর্বোচ্চ ব্যবহারে সচেষ্ট থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে পরিবারের সবাই মিলে কিছু গেমস খেলা, সিনেমা দেখা যেতে পারে।

এ সময় শিশুকে তার বয়স উপযোগী গল্পের বই পড়তে উৎসাহী করতে তোলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সময় কাটানোর ধরনটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মনে রাখতে হবে, শিশু বাবা-মায়ের কথা শোনার থেকে তাদের সম্পাদিত কর্মকে অনুসরণ করতে বেশি ভালোবাসে। সঙ্গে শিশুকে তার সহপাঠীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে, যা শিশুকে মানসিক সাপোর্ট দেবে।

যেহেতু কোভিড-১৯ মহামারিটি কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই, তাই হোম কোয়ারেন্টাইনে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক প্রভাবের বিষয়টি সব আক্রান্ত দেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। শিশুরা সব সময় শারীরিক, মানসিক এবং পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। তাই এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এড়াতে নিবিড় মনোযোগ এবং কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন।

এ ধরনের প্রোগ্রামকে সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ পারিপার্শ্বিক সব রকমভাবে টেকসই করতে গেলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। শিশুদের প্রয়োজনের সপক্ষে অ্যাডভোকেসি করার জন্য তাদের স্বাভাবিকভাবে কম ভয়েস থাকে। শিশুরা যেসব অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হচ্ছে, তা নিরসনে একটি সম্মিলিত এবং সামগ্রিক কৌশলপ গ্রহণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ আহ্বান জানায়।

সরকার, বাবা-মাসহ সব ধরনের স্টেকহোল্ডারকে এটি নিশ্চিত করতে হবে, কোভিড-১৯ মহামারির শারীরিক ও মানসিক প্রভাব শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের ওপর ন্যূনতম রাখা সম্ভব হয়েছে।

লেখক : চাইল্ড প্রটেকশন এক্সপার্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close