আমিরুল ইসলাম বাপন

  ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫

শিক্ষার সঙ্গে শরীফের জয়যাত্রা

ঢাকার কোলাহলপূর্ণ রাস্তায়, যেখানে মানুষের ভিড়ে জীবনের নানা গতি লক্ষ করা যায়, সেখানে একজন যুবক নীরবে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছেন দুর্বলদের পাশে দাঁড়াতে। তিনি হলেন শরীফ ওবায়দুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং নবোদ্যম ফাউন্ডেশন ও সেভ দ্য টুমরো স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। তার লক্ষ্য, পথশিশুদের জীবনে পরিবর্তন আনা এবং তাদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যতের সুযোগ তৈরি করা।

সহানুভূতির যাত্রা

শরীফের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানে তিনি পথে চলতে চলতে পথশিশুদের সংগ্রামের সাক্ষী হয়েছেন। ‘আমি দেখেছি যে, ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে চলা বেঁচে থাকার সংগ্রাম করা বাচ্চারা আমার চেয়ে খুব বেশি ছোট নয়। তাদের জন্য কিছু করতে হবে আমার’, স্মরণ করেন শরীফ। এই চিন্তা থেকেই তিনি নিজেদের ভেতর এক গভীর সহানুভূতি অনুভব করেন এবং কিছু করার সংকল্প নেন।

নবোদ্যম ফাউন্ডেশন: একটি লক্ষ্য বাস্তবায়ন

২০১৯ সালে শরীফ নবোদ্যম ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য হলো পথশিশুদের ক্ষমতায়ন করা এবং তাদের উন্নত ভবিষ্যতের সুযোগ প্রদান করা। ফাউন্ডেশনটি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এবং শিশুদের জীবন উন্নত করার জন্য একটি সামগ্রিক পদ্ধতির উপর কাজ করে। শরীফের নেতৃত্বে ফাউন্ডেশনটি দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জেলায় কার্যক্রম শুরু করেছে। সাক্ষরতা ক্লাস থেকে শুরু করে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মশালা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালু হয়। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাই দারিদ্র্যের চক্র ভাঙ্গার চাবিকাঠি। এই শিশুদেরকে শুধু জ্ঞান দিয়েই নয়, আমরা এমন দক্ষতায় গড়ি যা তাদের নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।’

সেভ দ্য টুমরো স্কুল: একটি নিরাপদ আশ্রয়

শরীফের নেতৃত্বে সেভ দ্য টুমরো স্কুল প্রতিষ্ঠা পায়। এই স্কুলটি পথশিশুদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। এখানে শিশুরা শেখার পাশাপাশি সৃজনশীল কার্যক্রমেও যুক্ত হয়। পাঠ্যক্রমটি জীবনের দক্ষতার সঙ্গে একাডেমিক বিষয়গুলোকে মিশ্রিত করে, যা শিক্ষার্থীদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে সাহায্য করে। স্কুলটির কার্যক্রম ঢাকা হাইকোর্টের সামনে এবং ভৈরব উপজেলার বেদেপল্লীতেও চলছে। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সুনামগঞ্জের মধ্যনগর, সাতক্ষীরার তালা উপজেলা এবং মিরপুরেও স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শরীফ বলেন, ‘আমরা তাদের আবেগকে প্রজ্বলিত করতে চাই এবং তাদের দেখাতে চাই যে তারা বড় স্বপ্ন দেখতে পারে।’

কমিউনিটি প্রভাব

সেভ দ্য টুমরো স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। নিবেদিত শিক্ষক এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় স্কুলটি খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ প্রদান করছে। অনেক শিশু এখন শিক্ষিত হয়ে উঠেছে এবং নতুন সম্ভাবনার সন্ধানে আগ্রহী। শরীফ বলেন, ‘প্রতিটি শিশুই একটি অনন্য গল্প নিয়ে আসে। আমরা সেই সম্ভাবনাকে লালন করার চেষ্টা করি এবং সমাজে তাদের স্থান খুঁজে পেতে সহায়তা করি।’

প্রতিকুলতা কাটিয়ে ওঠা

শরীফ তার কাজের গভীর প্রভাব সত্ত্বেও অসংখ্য প্রতিকুলতার সম্মুখীন হন। তহবিলের অভাব প্রায়ই একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও, তার অটল প্রতিশ্রুতি তাকে অনুপ্রাণিত রাখে। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি শিশু যে আমাদের প্রোগ্রামের মাধ্যমে আশা খুঁজে পায়, সেই সমস্ত সংগ্রাম এটাকে মূল্যবান করে তোলে।’

শরীফের আবেগ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদেরও আকৃষ্ট করেছে, যারা তার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করে। তারা বিভিন্ন তহবিল সংগ্রহের ইভেন্ট ও সচেতনতা প্রচারণা আয়োজন করে, যেন পথশিশুদের দুর্দশার কথা সমাজের কাছে তুলে ধরতে পারে। শরীফের কাজ শুধু শিশুদের সেবা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি শিশু নিগৃহীতার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজও করেন। তিনি স্থানীয় সম্প্রদায়, স্কুল এবং নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দুর্বল শিশুদের জন্য আরো ভালো সহায়তা ব্যবস্থা গঠনের আহ্বান জানান। ‘সচেতনতার মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব,’ তিনি উল্লেখ করেন।

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য

শরীফ ওবায়দুল্লাহর যাত্রা এক শক্তিশালী অনুস্মারক। তার গল্প আমাদের জানিয়ে দেয় যে, সহানুভূতি এবং সংকল্পের মাধ্যমে স্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘শিক্ষা শুধু অধিকার নয়; এটি পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।’

২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্থায়ী কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন শরীফ। ঢাকার সবচেয়ে অরক্ষিত শিশুদের জন্য আশার বাতিঘর হিসেবে শরীফের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ত্যাগ এবং সহানুভূতির মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর আগামী গঠনে সাহায্য করতে পারি। তার প্রচেষ্টা শুধুমাত্র শিশুদের জীবনই পরিবর্তন করছে না, বরং সমাজের সব স্তরের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করছে।

শরীফ আমাদের শেখায়, একা একা কিছু করা সম্ভব নয়, বরং একত্রে আমাদের সমষ্টিগত উদ্যোগেই একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের পথ খুলে যাবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close