মোহাম্মদ এনামুল হক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদারাসা, চট্টগ্রাম

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

সিলেটের আধ্যাত্মিক প্রান্তরে একদিন

হঠাৎ একদিন হামিদের ফোনকল পেলাম। সে বলল, ‘তুই যেহেতু বাড়িতে আছিস, চল আমরা শাহ জালাল (রহ.) মাজারে যিয়ারত করি।’ প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম। আমি জানতে চাইলাম, ‘তুই তো চট্টগ্রামে? কীভাবে আসবি?’ হামিদ বলল, ‘রাতে ট্রেনে করে সিলেট চলে যাব, আর তোদের জন্য অপেক্ষা করব।’

২২ অক্টোবর, আমি আর মঈন উদ্দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই হবিগঞ্জ সদর থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যাওয়ার আগেই মানিককে জানিয়ে রেখেছিলাম, ‘তোমাকে দেখতে আসছি।’ মানিক চট্টগ্রামের ছেলে। চাকরির সুবাদে সে সিলেটে এসেছে এবং প্রথমবারের মতো সিলেটে থাকার সুযোগ পেয়েছে।

সকাল দশটার দিকে আমরা সিলেট পৌঁছালাম। পথিমধ্যে মানিক বারবার ফোন করছিল, ‘আর কতক্ষণ লাগবে?’ আমরা তাকে আশ্বস্ত করলাম, ‘আর কিছুক্ষণ, প্রায় পৌঁছে গেছি।’ এরপর হামিদকে ফোন দিলাম, কিন্তু সে ধরল না। হয়তো সারা রাতের যাত্রার ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে ছিল।

আমরা সোজা পুলিশ লাইনের সামনে গিয়ে হামিদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর হামিদ এসে পৌঁছাল। ক্লান্ত চেহারা, তবুও আমাদের দেখে তার মুখে প্রশান্তির হাসি। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা মানিকের কর্মস্থল আম্বারখানা পিউরিয়া শো-রুমে হাজির হলাম। সকালের নাশতা সেরে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম।

যোহরের নামাজের সময় ঘনিয়ে এলো। এবার আমাদের মূল উদ্দেশ্যের পালা- শাহ জালাল (রহ.) মাজার শরিফে যিয়ারত। আমরা সোজা মাজার শরিফে চলে গেলাম। চারপাশে ভক্তদের ভিড়, পবিত্র পরিবেশ আর স্নিগ্ধ বাতাস আমাদের মনকে প্রশান্ত করল। যোহরের নামাজ আদায় করে আমরা মাজার শরিফে দোয়া করলাম। মনে হলো, সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।

হযরত শাহ জালাল (রহ.) ছিলেন একজন মহান সুফি সাধক। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ইয়েমেন থেকে সিলেটে আসেন। তার পবিত্র জীবনাদর্শ এবং অসাধারণ চারিত্রিক গুণাবলি অসংখ্য মানুষকে ইসলামের পথে আকৃষ্ট করেছিল। আজও তার মাজারে ভক্তদের ভিড় প্রমাণ করে, তার আধ্যাত্মিকতা কালের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।

মাজার শরিফ থেকে ফিরে আমরা গেলাম ‘পাঁচ ভাই হোটেল’-এ। সিলেটের বিখ্যাত এই হোটেলে খাবারের মান এবং পরিবেশ সত্যিই প্রশংসনীয়। মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখে প্রথমে কিছুটা অবাক হলাম, কিন্তু খাবারের স্বাদ পেয়ে সেই অপেক্ষার মূল্য পুরোপুরি পেলাম।

খাবার শেষে আমরা মানিককে নিয়ে সিলেট শহর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরবর্তী গন্তব্য শাহ পরাণ (রহ.) মাজার। মাজার শরিফে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এক অন্যরকম প্রশান্তি আমাদের ঘিরে ধরেছে। শাহ পরাণ (রহ.) ছিলেন হযরত শাহ জালাল (রহ.)-এর ভাগ্নে এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তার ত্যাগ, সাধনা আর ইসলামের জন্য অবদান আমাদের জন্য অনুকরণীয়।

মাজার থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম পামওয়েল পার্কে। প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরিবেশ, সবুজ গাছপালা আর মৃদুমন্দ বাতাস আমাদের মনকে প্রশান্ত করল। কিছুক্ষণ সেখানে বসে গল্প করলাম, ছবি তুললাম এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

রাত নেমে এলো। ক্লান্ত, কিন্তু তৃপ্ত হৃদয়ে আমরা হালকা নাশতা সেরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে সিলেটের রাতের আলোকিত শহরটিকে বিদায় জানালাম।

এই সফরটি কেবল একটি ভ্রমণ ছিল না; এটি ছিল আত্মিক প্রশান্তি এবং বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরো দৃঢ় করার এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। শাহ জালাল (রহ.) এবং শাহ পরাণ (রহ.)-এর মাজার যিয়ারতের মাধ্যমে যে মানসিক প্রশান্তি পেয়েছি, তা সত্যিই অনন্য।

সফরের শেষপ্রান্তে এসে মনে হলো- এই দিনটি জীবনের স্মৃতির পাতায় একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close