হাসিবুল হাসান হিমেল, ঢাকা কলেজ
গৌরবময় ১৮৪ বছরে ঢাকা কলেজ
দেখতে দেখতে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ১৮৩টি বছর পেরিয়ে গত ২০ নভেম্বর ১৮৪ বছরে পদার্পণ করলো ঢাকা কলেজ। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর জন্ম হয়েছিল উপমহাদেশের প্রথম এই আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দেশের সর্বপ্রাচীন ও গৌরবময় এ বিদ্যাপীঠটিকে।
দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের উচ্চশিক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে ভুগতে হয়েছে অস্তিত্ব সংকটেও। কিন্তু ওইযে কামিনী রায় বলে গিয়েছিলেন, ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলি দাও। তার মতো সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও’। কামিনী রায়ের উক্ত চরণ আর ঢাকা কলেজ যেন একই সূত্রে গাঁথা। কখনো নিজের সর্বস্বটুকু, কার্জন হল, শহীদুল্লাহ হল (ঢাকা হল) নিজস্ব ছাত্র-শিক্ষক দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের পুনর্বাসনের জন্য হাইকোর্টের নিজেদের কলেজ ভবনটিকে ছেড়ে দেওয়া। পরের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ায় ঢাকা কলেজের জুরি মেলা ভার। যেন সত্যিকার অর্থেই নিজেকে নিয়ে বিব্রত রহিতে ধরণীতে আসে নাই ঢাকা কলেজ।
এখন আসা যাক- কখন, কোথায় ও কিভাবে নিজের আত্মাকে উৎসর্গ করে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে সদা কাজ করে গেছে ঢাকা কলেজ সেই প্রসঙ্গে। ইতিহাস ঘাটলে ১৮৩ বছরের একটি সমৃদ্ধ ও গৌরবময় ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাবে উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির। ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ‘ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুল’ যেটি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত, প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ঢাকা কলেজের। যদিও এর তোরজোর শুরু হয়েছিল ১৮২৮ সালের দিকেই।
১৮৪১ সালে এর নামকরণ করা হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ এবং পরবর্তী সময়ে ১৮৪৫ সালে ঢাকা কলেজ নামকরণ করা হয়। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপরই ঢাকা কলেজকে এর অধিভুক্ত করা হয়। ১৮৭৫ সালে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান ক্লাস খোলার মাধ্যমে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার একমাত্র আতুরঘরে পরিণত হয় দেশের সর্বপ্রাচীন এ কলেজটি। এরপর ১৯০৮ সালে কার্জন হল নির্মাণকাজ শেষ হলে ঢাকা কলেজকে কার্জন হলে স্থানান্তরিত করা হয়। যখন শিক্ষায়, খ্যাতিতে, সুনামে ঢাকা কলেজের স্বর্ণযুগ চলমান, ঠিক তখনই তাকে দিতে হয় সেই মহান আত্মবলিদান।
১৯২১ সালে বর্তমান প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের সর্বস্বটুকু অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে ঢাকা কলেজ ঠাঁই নেয় লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বাসভবনে অর্থাৎ বর্তমান হাইকোর্টে। এভাবেই ঢাকা কলেজের মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু ঢাকা কলেজ তার পরবর্তী আশ্রয়টুকুও বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের পুনর্বাসনের জন্য ঢাকা কলেজকে তার হাইকোর্টের ভবনটিকে ছেড়ে দিয়ে আশ্রয় নিতে হয় লক্ষীবাজারে অবস্থিত ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে, যা বর্তমানে সরকারি কবি নজরুল কলেজ নামে পরিচিত। এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ তার আপন গৃহের ঠিকানা পায়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ধানমন্ডির মিরপুর রোডে স্থায়ীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনায় অব্যহত রয়েছে এ মহান বিদ্যাপীঠটি।
সব অপূর্ণতা ও অপ্রাপ্তিকে একদিকে রেখে গৌরবময় ১৮৪ বছরে পদার্পণ করেছে দেশের সর্বপ্রাচীন ও উপমহাদেশের সর্বপ্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। যতদিন বাংলাদেশ রবে, যতদিন বাঙালি রবে, ততদিন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে ঢাকা কলেজের নাম। তাই ১৮৩ তম জন্মদিন পার করে ১৮৪ বছরে এসে সব ডিসিয়ানদের একটাই প্রত্যাশা, চিরকাল বাংলার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুক প্রাণের ঢাকা কলেজ।
"