আল আমিন হোসাইন, রাবি
আমার চোখে আমার ক্যাম্পাস
ভর্তি পরীক্ষা নামক কোনো এক যুদ্ধ শেষে অবশেষে ভর্তি হয়েছি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বলা চলে আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৫ আগস্টের পর কোনো এক দাসত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে নবীনদের পদচারণায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে এই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাস জুড়ে দেখা যায় একঝাঁক প্রাণবন্ত, চঞ্চল নতুন মুখ।
প্রথমদিনে ক্যাম্পাসের গণ্ডিতে ঢোকার আগ মুহূর্তেই এক বৃহৎদকার উঁচু দরজা দেখতে পেলাম। বড় ফলক আকৃতিতে লেখা ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপিত ১৯৫৩ সালে ৬ জুলাই। এটি দেশের দ্বিতীয় প্রাচীন ও বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। মনে হলো এ যেন কোনো এক ‘ইউটোপিয়া’ রাজ্যে প্রবেশ করলাম। দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই বিশাল আকৃতির এক ভাস্কর্য, কাছে গিয়ে দেখলাম নাম ‘সাবাস বাংলাদেশ’ লেখা সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন :
‘সাবাস বাংলাদেশ
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
কি তারুণ্যের ছোঁয়া। উন্মোচন করেছিলেন জাহানারা ইমাম। পাশে সিনেট ভবন। মহাঅট্টালিকা প্রসাদের মতো একটি প্রশাসন ভবন দেখতে পেলাম সঙ্গে গোল আকৃতির সমাধি চত্বর সেখানে সমাহিত করা আছে ১৯৬৯ সালে শহীদ শামসুজ্জোহা স্যারকে। ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের নীল-সাদা বাস, পূর্ণাঙ্গ স্টেডিয়াম, শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সবকিছুর সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলাম। মাঝে বধ্যভূমির নিশ্চুপ নীরবতায় ইতিহাসের ভয়াবহতা ভেবে শিহরিতও হলাম। ক্যাম্পাসের আরেক চমক হলো ‘প্যারিস রোড’ মর্মঘাতী নিশীথে রাস্তার দুধারে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো কি সৌন্দর্যই না বিরাজ করছে। ৭৫৩ একরে ঘেরা আমার এই সবুজ চত্ত্বরে একের পর এক সাজানো একাডেমিক বিল্ডিং। এই রকম সাজানো ক্যাম্পাস দেশের আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই। মেধাবী আর পরিশ্রমির ক্যাম্পাসকে মনে হতে থাকে নিভৃত বন্ধু, মনে মনে তার সঙ্গে অজস্র কথা বলা যায়। নিভৃত বন্ধুই শিখিয়েছে, নিজের ভেতরে তাকাও। এটা শিখতে পারলে জীবনের মঞ্চে প্রথম সারিতে দাঁড়ানো যাবে অনায়াসে।
যতদিন গড়তে লাগল প্রাণের ক্যাম্পাস হয়ে উঠল আরো প্রাণের। নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হলো। বন্ধুরা সবাই পড়ে, কিন্তু আমি এর ফাঁকে নিজের পড়াশোনা নামক অবাস্তব অশরীরয় বস্তুটিকে হারাতে লাগলাম। গানে গানে আড্ডা, সিনিয়রদের থেকে নোট চাওয়া অথচ পরীক্ষা সম্মিলিত কোনো জ্ঞান আমার মস্তিষ্কে তখনো প্রবাহিত হচ্ছে না। বলা হয় কুমিল্লার দুঃখ নাকি গোমতী নদী। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রে দুঃখ নাকি টিউশন আর হলে সীট না পাওয়ার দুঃখ।
‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ পড়ার চিন্তা থেকে পরের বেলায় কী খাব; মা বাড়িতে অসুস্থ বাবার একমাত্র সম্বল গরুখানা তাও বিক্রি হয়নি, তাই টাকা আসতেও দেরি। এই ব্যথিত অপমানের ক্লান্ত জীবনও যেন সত্য-মিথ্যার কল্পকাহিনি। এছাড়াও বড় ভাইদের পাশে থেকে দেখা নির্মম সত্য সারাবছর ক্লাস, এসাইনমেন্ট, ক্লাসটেস্টের পর পরীক্ষার সময়গুলোতে ফটোকপির দোকানে ভিড় জমানো, ঘুমিয়ে পাড় করা ক্লাসগুলোর লেকচার। বন্ধুর কাছে ফটোকপি করার আকুতি। আবার তাদেরই ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়াটা বুঝি সব থেকে বিষাদগ্রস্ত সময়। তবে ক্যাম্পাসের সড়কে, চায়ের দোকানে, হলে কিংবা অনুষদের ভবনে রেখে যায় তাদের কয়েক বছরের স্মৃতি।
পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে থাকা কতগুলো মেধাবী তরুণদের হাসি কান্নার গল্প এই ক্যাম্পাস। প্রায় ৩০ হাজার অধিক সদস্যের একটি পরিবার আমাদের। শহীদ শামসুজ্জোহা স্যার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুখরঞ্জন সমাদ্দারসহ আরো কত গুণী মানুষদের উত্তরসূরি আমরা। স্নেহ, বন্ধুত্ব, বড়দের সম্মান, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, আবেগ, অনুভূতি, শিক্ষকদের ভালোবাসা, না খেয়ে থেকে স্বপ্ন বুননের কল্পনা, খেলাধুলা, দেশ সংষ্কার, বিদেশে উচ্চ শিক্ষা সবকিছু নিয়েই তৈরি আমার ক্যাম্পাস যেন শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে সবার আগে।
"