রাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নবীন মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ভাবনা
প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে পদার্পণ করা প্রতিটি নবীন ছাত্রীর জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তাদের কল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যেন রঙিন ও স্বাধীনতায় পূর্ণ এক ভুবন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৭১তম ব্যাচ (২৩-২৪)-এর ২২ সেপ্টেম্বর ক্লাস শুরু হওয়ার পর ৪৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে এর মধ্যে তারা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কিছু মেয়ে শিক্ষার্থীর ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, সমস্যা, অভিজ্ঞতা ও ক্যাম্পাস নিয়ে অনুভূতি সংগ্রহ করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগেরী শিক্ষার্থী- আল আমিন হোসাইন
মেয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটে রাবি ক্যাম্পাস
বরেন্দ্রভূমিতে অবস্থিত ৭৫৩ একরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। রাবির যথেষ্ট সুনাম ও খ্যাতি থাকলেও রয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের কিছু সীমাবদ্ধতা। তার মধ্যে আবাসন সংকট অন্যতম। প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী তিনটি বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু আবাসনের অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকাগুলোতে তুলনামূলক বেশি দামে মেস বা বাসা ভাড়া নিতে হয়। এতে যেমন তাদের অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় তেমনি মেস মালিকদের রূঢ় আচরণ সহ্য করতে হয়। অতিরিক্ত ভাড়া, খাওয়া খরচ, পড়াশোনার আনুষঙ্গিক খরচের কারণে শিক্ষার্থীদের (বিশেষ করে মেয়ে) বাড়তি মানসিক চাপ ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই আবাসন সংকট নিরসন করা গেলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস জীবন আরো মনোরম ও সুশৃঙ্খল হত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হলো সবচেয়ে উপভোগ্য ও রোমাঞ্চকর জীবন। একই সঙ্গে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় এই সময়ে। তাই আমার মতো হাজারো মেয়ে শিক্ষার্থীদের আশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন মেয়েদের শতভাগ আবাসন নিশ্চিত করে। এক্ষেত্রে আশার বাণী হলো-স্বায়ত্বশাসিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যাপ্ত পতিত ভূমি রয়েছে। প্রশাসনের উদ্যোগে এই স্থানগুলোতে আবাসনের জন্য হল নির্মাণ করা হলে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট কিছুটা লাঘব হবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা। চোখে-মুখে স্বপ্ন এঁকে আসা তরুণ ও উদ্দীপ্ত স্বপ্নচারীদের আবাসন সংকট কোনো বাঁধা না হোক এটাই প্রত্যাশা।
হোমায়রা আক্তার (হীরা)
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ক্যাম্পাসে আত্মনির্ভরশীলতা ও স্বাধীনতায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা
বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ক্ষেত্রে নারীরাও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। চার দেয়ালের বন্দি জীবন অথবা সমাজের নিপীড়ন, অবহেলা আর অসমতার ক্ষুদ্র গন্ডিতে বেঁধে রাখা নারীরাও সব প্রতিবন্ধকতা এবং সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে স্বপ্ন দেখছে সোনালি ভবিষ্যতের। একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভর্তিযোদ্ধার শত প্রতিক্ষা আর প্রত্যাশার অবসান ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানে চান্স পাওয়ার মাধ্যমে। এখানেই একজন স্বপ্নদ্রষ্টা আত্মনির্ভরশীলতার স্বপ্ন দেখে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের আত্মনির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে তেমনি একটি স্বপ্নের ঠিকানা। আপন মানুষগুলোর থেকে দূরে একটা সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে শেখায় বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠান। চোখে থাকে স্বপ্ন, আত্মনির্ভরশীল সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের আত্মনির্ভরশীলতা বা স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেমন এখানে বিভিন্ন সংগঠনে যোগদানের মাধ্যমে মেয়েরা তাদের নিজস্ব লুকায়িত মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে যা তাদেরকে আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করতে পারে। এসব সংগঠনে বিভিন্ন খেলাধুলা, সংগীত, বিতর্ক, সামাজিক সেবা এবং অন্যান্য কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমগুলোতে একদিকে যেমন তারা তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে ঠিক তেমনভাবে তাদের স্বনির্ভরতার পথ খুঁজে পেতে পারে। তাছাড়া ১৫টি সংগঠন নিয়ে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক ফোরাম, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং ফোরামসহ বিভিন্ন হল ভিওিক বিতর্ক ক্লাব। এরূপ মুক্ত জ্ঞানচর্চায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা খুঁজে নিতে পারে তাদের আত্মনির্ভরতার পথ। বর্তমানে ক্যাম্পাসে মেয়েরা একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন পার্ট টাইম জব, অনলাইন বিজনেস অথবা বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে উপার্জন করছে।
সোনালী
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মেয়েদের নিরাপত্তা চাদরে রাবির ক্যাম্পাস
বাংলাদেশ একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায়ে হলো বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবছর ভর্তি যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেয়ে সফলতার সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের আসন সুনিশ্চিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের সঙ্গে জ্ঞান এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চা ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত থাকলেও প্রায়ই নারীদের টর্চার ও যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ঘটতে শোনা যাচ্ছে। যা নারীদের উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পথে এক বিরাট বাধা। সবুজের ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর এই ক্যাম্পাস যেমন আমাদেরকে পড়াশুনার উপযুক্ত পরিবেশ দিয়েছে, তেমনিভাবে একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে পেয়েছি শিক্ষা অর্জনের জন্য নিরাপদ পরিবেশ। রাতে নারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ভেতরে অবাধ চলাচল করতে পারে। কোনো নারী শিক্ষার্থী যেন নিরাপত্তা জনিত কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মহোদয় সর্বদা সচেষ্ট। এছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন? নিরোধ নীতিমালা, ২০১০ কার্যকর রয়েছে। এর আওতায় সংশ্লিষ্ট হয়রানি বা নিপীড়নের প্রতিবিধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট অনুমোদিত একটি যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেল রয়েছে যা নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এছাড়াও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষার্থী হয়ে যেকোনো সময় নিরাপত্তা জনিত যে কোনো বিষয় যাতে আমরা আমাদের নারী প্রভাষকদের? নিকট প্রকাশ করতে পারি সেজন্য তারা আমাদের প্রতি সর্বদা মায়ের মতোই আন্তরিক। সব কিছুর পাশাপাশি আমাদের প্রতি প্রবীণ আপুদের দায়িত্বশীলতার কথা যেন না বললেই নয়। একজন নারী শিক্ষার্থী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমার অন্যতম বড় প্রাপ্তি।
আনিশা
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মেয়েদের ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ক্যাম্পাস
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন নারী শিক্ষার্থী হয়ে আমাদের সামনে যেমন স্বাধীনতার সুযোগ আসে, তেমনই আসে ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দায়িত্ব ও নতুন চ্যালেঞ্জ। এই সময়টিতে একজন মেয়ের জীবনের পরিকল্পনা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং বাস্তবমুখী শিক্ষা ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ক্যারিয়ার আমরা বাছাই করলেও এইটা নিশ্চিত করতে পারি না যে ভবিষ্যতে কোনো সুফল নিয়ে আসবে কি না। এই পর্যায়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং বা পরামর্শ গ্রহণ করা অনেক উপকারী হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার সেন্টার বা পরামর্শদাতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ক্যারিয়ার পরিকল্পনা করতে পারলে, আমরা লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পারব। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি নানারকম দক্ষতা অর্জন করতে হয়, যেমন- যোগাযোগ দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলি, দলীয় কাজের দক্ষতা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা। বিভিন্ন ক্লাব, সেমিনারের মাধ্যমে এসব দক্ষতা উন্নয়ন করা সম্ভব। এতে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং বাস্তব জীবনের সেইসব দক্ষতা প্রয়োগ করতে পারি। একজন সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নেটওয়ার্কিং। বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষক, সিনিয়র, অ্যালামনাই করে আমরা যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে পারি। টাইম ম্যানেজমেন্ট বা সময় ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আর প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের উচিত ক্যারিয়ার গঠন ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা। নিজেদেরকে নানাভাবে দক্ষ করে তোলা এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা যা আমাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে সফল হতে সাহায্য করবে।
সুরাইয়া
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মেয়েদের হলে খাবারের মান বৃদ্ধি প্রসঙ্গে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে উঠেছে আমার দ্বিতীয় বাড়ি। নিজের বাড়ির মতো সবকিছু না হলেও, খাবার খেতে বসে বাড়ির কথা মনে পড়াটা নিত্তনৈমিত্তিক বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের খাবার নিয়ে এর আগেও অনেক লেখালেখি হয়েছে। একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হিসাবে রোজ রোজ ভালোমন্দ খাওয়া সকলের জন্য সম্ভব না। তাদের কাছে অল্প দামে ভালো খাবার খাওয়ার একমাত্র ঠিকানা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। তবে দামে ২৮ হলেও কী মানে ভালো? খাবারের মান ও স্বাদের কথা বলতে গেলে অনেকের এ ব্যাপারে অভিযোগ আছে। একজন মেয়ে শিক্ষার্থীর খাবারের পুষ্টি, পর্যাপ্ত প্রোটিন, প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবে স্বাস্থ্য সমস্যা হয়। এছাড়া খাবার পরিবেশনের জায়গাগুলোতেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে দেখা যায় না। যা শিক্ষার্থীদের অসন্তোষের কারণ। আমরা কম খরচে মানসম্মত খাবারে আশা করলেও অনেক সময় তা সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিটরিং বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে নিয়মিত নজরদারি রাখতে হবে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে এবং মেন্যুতে বৈচিত্য আনতে হবে। খাবার পরিবেশনকারীদের খাবারের মান ও পরিছন্নতার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারি থাকলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আমরা সক্ষম হব।
হিয়া
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
"