ইভা আক্তার, গবি

  ১৩ নভেম্বর, ২০২৪

ক্যানসার চিকিৎসায় মেডিকেল ফিজিসিস্ট

রোগ-বালাই মানুষের নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে অন্যতম ক্যানসার, যার নেই কোনো বিধিনিষেধ। লসিকা থেকে শুরু করে অস্বাভাবিক গতিতে ছড়িয়ে পরে সম্পূর্ণ শরীরে। যার পরিপূর্ণ চিকিৎসা না পাওয়া পর্যন্ত শরীরে কোষ বিভাজন হতে থাকে। এই ক্যানসার চিকিৎসায় চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। হাসপাতালে আধুনিক যেসব যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করা হয়, তা থাকে চিকিৎসা পদার্থবিদদের তত্ত্বাবধানে।

প্রতিবছর ৭ নভেম্বর মেডিকেল ফিজিক্স দিবস পালিত হয়। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘চিকিৎসা পদার্থবিদদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করা’। মেডিকেল ফিজিক্স দিবসের উদ্দেশ্য পেশার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে মানুষ কি আসলেই সচেতন? বাংলাদেশে কি আদৌ চিকিৎসায় যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসা পদার্থবিদদের কাজে লাগানো হচ্ছে? এ চিত্র তুলে ধরেছেন ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল এবং সুপার স্পেশালিটি সেন্টার’র মেডিকেল ফিজিসিস্ট এবং রেডিয়েশন কন্ট্রোল অফিসার, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ফিজিক্স এন্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো, জোবায়রুল ইসলাম।

ক্যানসার চিকিৎসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো রেডিওথেরাপি। গবেষণা অনুযায়ী, ক্যানসার চিকিৎসার ৬০-৭০ শতাংশ রোগী রেডিওথেরাপির আওতায় আসেন। চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার কোষের ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, যাতে তা আর বিভাজিত বা বৃদ্ধি হতে না পারে।

রেডিওথেরাপিতে ব্যবহৃত উচ্চ শক্তির বিকিরণ যেমন ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে পারে, তেমনি অপ্রয়োজনীয় বিকিরণ সুস্থ কোষের ক্ষতিও করতে পারে। এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজ ও জটিল প্রক্রিয়া, যা বাস্তবায়নের জন্য রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, মেডিকেল ফিজিসিস্ট এবং রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট— একটি দল হিসাবে কাজ করে, যেখানে প্রত্যেকের দায়িত্ব অতি সূক্ষ্মভাবে নির্ধারিত। মেডিকেল ফিজিসিস্টরা ক্যানসার চিকিৎসার এই জটিল প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কার্যকর করার অন্যতম মূল কারিগর।

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, মেডিকেল ফিজিক্সে কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য অন্তত দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোতে, এই নিয়ম কঠোরভাবে মানা হয়, যাতে রোগীরা সঠিক, নিরাপদ ও মানসম্পন্ন সেবা পায়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ফিজিক্সে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, এই ক্ষেত্রের আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যোগ্যতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমাদের দেশে এখনো তেমন নজর দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অন্য বিষয়ের স্নাতকধারী শিক্ষার্থীরা এই বিশেষায়িত পেশায় যোগদান করছে, যা আন্তর্জাতিক নীতিমালার বিপরীতে এবং আইনিভাবে অবৈধ। এই ধরনের অব্যবস্থা শুধুমাত্র আইনের লঙ্ঘন নয়, বরং এটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানের ওপরও ঝুঁকি তৈরি করছে।

রেডিয়েশন থেরাপি, নিউক্লিয়ার মেডিসিন এবং ডায়াগনস্টিক রেডিওলজি- এই তিনটি বিভাগে মেডিকেল ফিজিসিস্টদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা রেডিয়েশন থেরাপি বিভাগে বিভিন্ন মেশিন নির্বাচন, বিকিরণ উৎসের সঠিক ব্যবহার, মান নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা করেন। পাশাপাশি ব্রাকিথেরাপির সময় বিকিরণ উৎসের সঠিক মান নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিত এবং রেডিয়েশন অনকোলজিস্টদের পরামর্শে রেডিওথেরাপি রোগীদের সঠিক চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন।

মেডিকেল ফিজিসিস্টরা রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে সিটি স্ক্যান ও অন্যান্য ইমেজিং প্রযুক্তির সহায়তায় প্রয়োজনীয় স্থানে সুনির্দিষ্ট রেডিয়েশন মাত্রা বন্টন করেন, যাতে ক্যানসার কোষ ধ্বংস হয় এবং আশপাশের সুস্থ কোষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। রেডিওথেরাপি বিভাগ ব্যতিত নিউক্লিয়ার মেডিসিন এবং ডায়াগনস্টিক রেডিওলজি বিভাগে মেডিকেল ফিজিসিস্ট ও রেডিয়েশন কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন।

মেডিকেল ফিজিসিস্টরা ইমেজিং, বিকিরণ চিকিৎসা এবং বিকিরণ সুরক্ষার সমস্ত বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত দিক দেখভাল করেন এবং নিশ্চিত করেন রোগীদের সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। তবে দেশে ডায়াগনস্টিক রেডিওলজি বিভাগে মেডিকেল ফিজিসিস্টদের আনুষ্ঠানিক নিয়োগ ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি। ফলে এমআরআই (গজও), সিটি স্ক্যান (ঈঞ-ঝপধহ), এক্স-রে (ঢ-ৎধু), ম্যামোগ্রাফি ইত্যাদি অতি সংবেদনশীল যন্ত্রগুলো মান নিয়ন্ত্রণ ও মেডিকেল ফিজিসিস্টদের তত্ত্বাবধান ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে, যা রোগীর সুরক্ষা এবং চিকিৎসার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্বজুড়ে ক্যানসার চিকিৎসার আধুনিকায়ন ও এর জটিলতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দক্ষ মেডিকেল ফিজিসিস্টদের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। তবে, বাংলাদেশে সরকারী হাসপাতালগুলোতে এই গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবীদের সরকারি নিয়োগ ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি। যদিও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রেডিওথেরাপি বিভাগে দক্ষ মেডিকেল ফিজিসিস্টদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল ফিজিক্স সোসাইটির (ইগচঝ) দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সরকার মেডিকেল ফিজিসিস্টের জন্য পদ সৃজনের অনুমোদন দেয়। তবে এখনো সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়নি। ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে আধুনিক রেডিওথেরাপি মেশিনগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে ক্যানসার রোগীরা উন্নত ও নিরাপদ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।

উন্নত দেশের মতো, বাংলাদেশেও চিকিৎসা পদার্থবিদদের কাজে লাগানোর জন্য পদ সৃজন এবং আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাজীবী নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়ন করা একান্ত প্রয়োজন। সরকারের এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যা ক্যানসার চিকিৎসায় বাংলাদেশের সাফল্যকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নেবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close