reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১২ নভেম্বর, ২০২৪

অংশীজনের ভাবনার আগামীর ছাত্ররাজনীতি

বলা হয় মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। ইতিহাসের সেই আদি থেকেই চলেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকেই অংশীজনদের মধ্যে বিভিন্ন সময় আলোচনা চলেছে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে। কখনো দাবি উঠেছে নিষিদ্ধের, কখনো আংশিক বর্জনে। সেসব দোলাচাল ভেদ করতেই গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছেন সানজিদা জান্নাত পিংকি

ছাত্র-রাজনীতিকে মুরব্বিমুক্ত করতে হবে

ছাত্রজীবন মানুষের জীবনের স্বর্ণসময়। ছাত্ররাই আগামীর কান্ডারী। কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ছাত্রসমাজের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। তবে বিগত শতাব্দীতে ছাত্ররাজনীতির বীরসেনাদের গৌরবগাথা এ শতাব্দীতে নব্য-ফ্রাংকেনস্টাইনে রূপপরিগ্রহ করেছে। এই মূহূর্তে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেই দেশ রাহুমুক্ত হয়ে যাবে না। এখন ছাত্ররাজনীতির আমূল সংস্কার জরুরি। তার আগে জরুরি জাতীয় রাজনীতির সংস্কার। ছাত্ররাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতি নিরবচ্ছিন্ন বিষয়। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত লেজুড়বৃত্তিক দলীয় রাজনীতি। এই লেজুড়বৃত্তিক দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে মুরব্বিদের হাজারো গাড়িবহরসহ প্রটোকলের বাসনা পরিহার করতে হবে। ছাত্ররাজনীতিকে অবশ্যই শতভাগ মুরব্বিমুক্ত করে শুধু নিয়মিত ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রনেতাদের ছাত্রজীবনেই উচ্চাভিলাষী জীবনানন্দ পরিত্যাগ করে, শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব-বলয়মুক্ত হয়ে ছাত্রদের কল্যাণার্থে গঠনমূলক রাজনীতিচর্চার পাশাপাশি বিপদ-শ্বাপদ-সংকট-সংকুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বার্থে নিয়োজিত হতে হবে। তাহলে ছাত্রদের হাতেই গঠিত হবে প্রত্যাশিত বৈষম্যহীন স্বপ্নের বাংলাদেশ।

মো. আল-আমীন হুসাইন

প্রভাষক

রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগ

রাজনৈতিক সংগঠনগুলো হয়ে উঠেছে পকেট সংগঠন

বাংলায় ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস যথেষ্ট সমৃদ্ধ, এই রাজনীতির প্রসার শুরু হয় ১৯ শতকের গোড়ায়। রাজনীতির কেন্দ্রে তখন লেজুড়বৃত্তি কোনো সিলসিলার বদলে শক্তিশালী ছিল অধিকার-কেন্দ্রিক সচেতনতা। পেছনের সময়গুলোয় সংসদকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রখর ছিল। কোনো দলীয় কার্যে সোপর্দ হওয়া ছিল অযাচিত কাজ। কেননা তারা আভাস পেয়েছিলেন সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব রাজনৈতিক নেতাদের হাতে যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, এ যাবৎ পর্যন্ত বেশির ভাগ ছাত্র সংগঠন পরিচালিত হয়ে আসছে রাজনৈতিক নেতাদের অধীনে, যা কোনোরূপেই কাম্য নয়। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সবেই শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, সবকিছুর কেন্দ্রে ওই অধিকার এবং অধিকারের জন্য লড়ে যাওয়া। প্রচলিত রাজনীতিতে কাঠামো বলে অবশিষ্ট কিছু নেই। দরকার যথাযথ বিনির্মাণ। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো হয়ে উঠেছে পকেট সংগঠন, যত্রতত্র চাঁদাবাজি-রাহাজানি। ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্র হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারণ সেখানে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে আলাপচারিতা চলবে, আন্দোলন হবে, শিক্ষার্থীরা শিখবে কী করে পরবর্তী জীবনে দাবি কী করে আদায় করতে হয় সম্পূর্ণ সম্মান-পূর্বক কোনোপ্রকার হিংস্রতা না দেখিয়ে। কিন্তু বর্তমান ছাত্ররাজনীতি অনেকটাই এর বিপরীতে। প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রসংসদ চালু করে শিক্ষার্থীদের কাঠামোগত রাজনীতির সুযোগ দিতে হবে, যাতে পকেট রাজনীতি থেকে সমাজ মুক্ত হয়।

তাওহীদ আহমদ সালেহীন

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বসংকট তৈরি হয়েছে

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত কি না, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির আগেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেছে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিগত ৫ হাজার বছরের মধ্যে বাংলার সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারের পতন, সব জায়গাতেই নেতৃত্বের সর্বাগ্রে ছিল ছাত্ররা। ছাত্র-জনতার সমান এত রক্তদান আর কোনো শ্রেণিপেশার মানুষই দেয়নি। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও যেকোনো জরুরি বিষয়ে সবার আগে পথে নেমে এসেছে এই ছাত্ররাই। শিক্ষার্থীরা অধিকার ও রাজনীতিসচেতন না হলে আজকের এই সফলতা অর্জন করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ত। এমন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থাকার পরও কেউ যদি ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকার দোলাচলে দুলতে থাকে, তবে সেটা অনভিপ্রেত। তবে এটিই শেষ কথা নয়। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে জনমনে ছাত্ররাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা কেন তৈরি হলো। এর একটা বড় কারণ হলো, ছাত্ররাজনীতি তার পথ হারিয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে এখন রাজনীতির চেয়ে শত গুণ বেশি হয় তোষামুদি। দলের রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি রাজনীতি মুখ্য হয়ে গেছে। দেশের জন্য রাজনীতি করার চেয়ে নিজ ও দলের রাজনীতিই প্রধান হয়ে উঠেছে। নিকট অতীতেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার লোক পাওয়া যায়নি। প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনার সুযোগ কম ছিল। জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বসংকট তৈরি হয়েছে। সংসদে একটা বড় অংশ ছিল ব্যবসায়ী। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ সংস্কারের কার্যক্রম চলমান। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকা বিষয়ে তারা কী ভাবছে, সেটা আমরা এখনো জানি না? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পূর্ণ বিরাজনীতিকরণ করা হলে এর ফলাফল হবে ভয়াবহ। এ থেকে মুক্তির পথ হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি থাকতে হবে। তবে সেটি কোনো দলীয় ব্যানারে নয়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ চালু করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নিষ্ক্রিয় আছে, সেগুলো সচল করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আমাদের মেধাবী সন্তানরা যেন আসতে পারে সে পথ আমাদেরই তৈরি করে দিতে হবে।

কাউছার আহমেদ

প্রভাষক, আইন বিভাগ

ছাত্ররাজনীতিকে বিতর্কিত করেছে সন্ত্রাসীরা

ছাত্ররাজনীতি বললেও এর বিষয়বস্তু শুধু ছাত্রতেই সীমাবদ্ধ নেই, দেশ জুড়ে এর বিচরণ। ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো স্বার্থে সদা তৎপর থেকে অধিকার আদায়ের পক্ষে আওয়াজ তোলাই মূলত ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন কেন? একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় দেশব্যাপী ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। দেশের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হতদরিদ্র হওয়ায় এদের মধ্যে রাজনৈতিক জ্ঞান খুবই সল্প। বাংলাদেশে রয়েছে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চেতনার অভাব, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব। আরো আছে নেতাদের ব্যক্তিস্বার্থ। এসবের ফলে দেশে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। ছাত্ররাজনীতি দরকার কেননা এটি ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক নেতার শাসন থেকে বাঁচার তাগিদ দেয়, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হতে শেখায়। দেশের মানুষকে প্রকৃত স্বার্থ আদায়ে আওয়াজ তুলতে শেখায়। এ ছাড়া আমার মতে, ছাত্ররাজনৈতিক বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুষ্ঠু রাজনীতির করা শেখায়। তাই এর প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করার উপায় নেই। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভীতির কারণ, তবে লক্ষণীয় স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি বিশেষত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার ছাত্ররাজনীতিকে বিতর্কিত করছে। বিশেষত সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। কিছু নামধারী ছাত্রনেতা নিজেদের ঠুনকো পরিচয়ে করেছে- সিটবাণিজ্য, ডাইনিংয়ে বিনামূল্যে খাওয়া, বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করার মতো জঘন্য অপরাধ। এদের ক্ষমতার দাপটে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হয়ে পড়ত কোণঠাসা। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এরা হত্যাযজ্ঞও চালিয়েছে। তবে চলমান সময়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যেসব সংশয় দেখা দিয়েছে, শিগগিরই শক্ত হাতে এর সমাধান করতে হবে। ছাত্ররাজনীতিকে লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেদের জায়গাটাকে শক্ত করতে হবে। ছাত্ররাজনীতির শুদ্ধতা এবং জৌলুস ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে এটি হবে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময়।

আদিবা রহমান

শিক্ষার্থী

ইংরেজি বিভাগ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close